৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে৷ ঐ শাসনামলে সাংবাদিকদের অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়৷ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে পরিস্থিতি কেমন?
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সাংবাদিকতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে আমার মনে হচ্ছে না৷ আগে এক পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে নির্দেশনা আসতো, এখন আরেক পক্ষ থেকে আসে৷ ফলে আগেও সাংবাদিকরা স্বাধীন ছিলেন না, এখনো নেই৷ বরং শতাধিক সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামী হওয়ার ফলে তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ সাংবাদিক সংগঠনগুলো আগে এক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন আরেক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করছে৷ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা সরকারের পতনের পর নতুন সরকারের কাছে মানুষের যে আকাঙ্খা ছিল, সেটা পূরণ হচ্ছে না৷”
৫ আগস্টের পরে সাংবাদিকতায় কী কী পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা বিভাগের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এত দ্রুত তো গুণগত পরিবর্তন দেখা যায় না৷ এর জন্য আরো কিছুটা সময় লাগবে৷ এটা খুব বেশি দৃশ্যমান না৷ একটা পরিবর্তন আছে ,সেটাতে পত্রিকায় বা টেলিভিশনে কী প্রভাব পড়ছে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আগে যে ভয়ের সংস্কৃতি ছিল সেটা কিছুটা দূর হয়েছে৷ কিন্তু পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো সরকারকে খুশি করার সাংবাদিকতা করছে৷ বিএনপিকে খুশি রাখার একটা চেষ্টাও আছে৷ এটা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক৷ আগে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতো না, এখন কথা বলা যাচ্ছে৷ ভয়ের সংস্কৃতি যদি না থাকে, তাহলে সামনের দিনে হয়ত একটা ইতিবাচক চিত্র দেখা যাবে৷ তবে ভয়ের সংস্কৃতি দূর হচ্ছে বলা হলেও আরেক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে৷ সেটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে৷ কেউ কোনো অপরাধ করলে সেটার তদন্ত বা বিচার হতে পারে, কিন্তু ঢালাও হত্যা মামলা বা হয়রানি ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাধা৷”
এ প্রসঙ্গে নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল ৬ সেপ্টেম্বর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো আগে আওয়ামী সরকারের মাউথপিস ছিল, এখন বিপ্লবী সরকারের মাউথপিস হয়েছে৷ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ভাষ্য/প্রেস রিলিজ হুবহু খবর আকারে ছাপিয়ে দিলে পত্রিকা বের করার দরকার কী?’’
সময় টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মার্জিয়া হাশমী মুমু বলেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান আওয়ামী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল৷ ‘‘প্রতিবেদকরা ফিল্ড থেকে নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদনের স্ক্রিপট লিখে পাঠালেও সেটা পরিবর্তন করে দেয়া হতো,’’ বলেন তিনি৷ আর এখন তিনি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন বলে জানান৷ ‘‘গুমের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারছি৷ আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা লাগছে না,’’ বলেন মুমু৷
ডেইলি স্টারের বাংলা বিভাগের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, আগে যে ভয়ের সংস্কৃতি ছিল সেটা কিছুটা দূর হয়েছে৷ কিন্তু পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো সরকারকে খুশি করার সাংবাদিকতা করছে, বিএনপিকে খুশি রাখার চেষ্টাও আছে৷ এটা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক৷ আগে যেসব নিয়ে কথা বলা যেত না, এখন বলা যাচ্ছে৷ তবে আরেক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে৷ সেটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে৷
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষক ফারজানা আক্তার মনে করেন, জুলাই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ও সংস্কারমূলক সংবাদ প্রচার বেড়েছে৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু নীতিবহির্ভূত সংবাদচর্চা অপশাসনকে আবারও আমন্ত্রণ করতে পারে৷’’ সংবাদ পরিবেশন এখন অনলাইন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় আরো বেশি জনবান্ধব ও গণতন্ত্রমুখী সংবাদ পরিবেশন জরুরি বলে মনে করেন তিনি৷
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান আলোকচিত্রী আব্দুল গনি জানান, ১৫ আগস্টের ছবি তুলতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন৷ তার তোলা ছবি মুছে দেওয়া হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখনও সাংবাদিকতার পরিবেশ পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়৷ আগের বাধাগুলো এখনো পুরোপুরি কাটেনি৷ আগের তুলনায় ছবি প্রকাশ অনেক স্বাভাবিক হয়েছে, তবে পুরোপুরি ভয়মুক্ত বলা যাবে না৷’’
ক্যানভাস ম্যাগাজিনের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফুয়াদ রূহানী খান মনে করছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অগাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে৷ গত একমাসে গণমাধ্যম অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার পাশাপাশি দেশে সংঘটিত নানা ধরনের অসামঞ্জস্য তুলে ধরেছে৷ বিগত সরকারের অপশাসনের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের গৃহীত নানা কর্মসূচি তুলে ধরতে দেখা যাচ্ছে৷
ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জায়মা ইসলাম বলেন, গত এক দশকে চরমমাত্রার সেন্সরশিপের ফলে গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং পাঠকদের বিশ্বাস হারিয়েছে৷ এমন পরিবেশে সাংবাদিকরা প্রতিদিন ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন৷ বিগত শাসকের প্রতি অনুগত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের উদ্বেগজনক৷ যতই একপেশে হোক না কেন, সাংবাদিকতা অপরাধ নয়৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনোভাবেই বাধা দেওয়া যাবে না৷
নিউ এজ পত্রিকার সিনিয়র কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বলেন, ৫ আগস্টের আগে একটি অস্বস্তিকর চাপা পরিবেশ বিরাজ করতো, যা এই মুহূর্তে অনেকটাই শিথিল৷ আগে যেসব বাধা ছিল তা এখন না থাকলেও ভিন্নরকম বাধার জন্ম হচ্ছে৷ বেশ কিছু দৃশ্যমান নৈরাজ্য, সংখ্যালঘু অত্যাচার ও মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে মূলধারার অনেক মিডিয়াই এখনও যেন ঠিক স্বচ্ছন্দ নয়৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, আগে সাংবাদিকতা ছিল বাক্সবন্দি৷ সরকারি সংস্থাগুলোর নির্দেশ অনুসরণে সাংবাদিকতার মূলনীতিগুলো ছিল আপসকামী৷ এখন পরিস্থিতির বদল হয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকতা প্রত্যাশিত মানে পৌঁছায়নি৷ উল্টো সাংবাদিকতা হয়ে গেছে প্রটৌকল নির্ভর৷ উপদেষ্টা পরিষদ, সেনাবাহিনী, সমন্বয়ক, প্রভাবশালী দলের প্রটৌকল মেনে তথ্য দেওয়া নিয়ত অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে৷
লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক রেদওয়ান আহমেদ মনে করেন মিডিয়ায় সংস্কার দরকার৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘বেশিরভাগ সিনিয়র সাংবাদিক যারা হয়তো বদলটা আনতে পারতেন, তারা এখন কার্যত অচল৷ তারা শুধু দল পাল্টাবেন, ভোল পাল্টাবেন৷ ক্ষমতার কাছে থেকে ফায়দা নেয়ার পাঁয়তারা করছেন ও করবেন৷ তাই তরুণদের মধ্য থেকে নতুন নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে৷ তা না হলে আমি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে নিকট-ভবিষ্যতে অতোটা আশাবাদী না৷’’
বর্তমানে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোবাশ্বার হাসান ২০১৭ সালে প্রায় দেড় মাস নিখোঁজ ছিলেন৷ ৩১ আগস্ট ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘‘মিডিয়ার কাছে জানতে চাই গণহত্যা চালানোর পেছনে কুশীলব কারা? প্রাক্তন শাসক দলের কারা গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন, আয়নাঘরের পেছনের কুশীলব কারা, চেহারা কেমন?’’ বাংলাদেশের ইতিহাসের কঠিনতম নিপীড়নের মুখে বিএনপি কীভাবে শক্তিশালী হয়ে টিকে আছে (তার মতে) তা নিয়ে প্রতিবেদন চান তিনি৷
আপনার মতামত জানানঃ