বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ছাত্র আন্দোলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গুলিতে দুই শতাধিক নিহত এবং প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার হয়েছে। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দমন করতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিকে অনেকেই নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করছেন।
ইন্টারনেট সংযোগ চালু হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবি প্রকাশ হয়েছে, যা চরম উদ্বেগ তৈরি করেছে। এরকম কয়েকটি ভিডিও যাচাই করে সেগুলো এবার আন্দোলনের সময় ধারণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ৫১ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের একটি ভিডিও নিয়ে বেশ হই চই হয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায় নির্মানাধীন ভবনে রড ধরে ঝুলে আছেন একজন তরুণ। দূর থেকে ধারণ করা ওই ভিডিওতে দেখা যায় লুকিয়ে থাকা ওই তরুণকে দুজন এসে পর পর অন্তত ছয় রাউন্ড গুলি করে।
গণমাধ্যম ওই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে ঢাকার রামপুরা থানার কাছে নির্মানাধীন ও ভবনের আশপাশের লোকজন, পাশ্ববর্তী হাসপাতাল এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে যে, ১৯ জুলাই শুক্রবার ওই ভবনে একজন তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
ভিডিওতে দৃশ্যমান অস্ত্রধারীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে সাধারণ মানুষ এবং মানবাধিকার কর্মীদের কাছে তাদেরকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতোই মনে হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনের নজরে এসেছে ওই ভিডিওটি।
তিনি বলেন, “একটি মানুষ পালিয়ে আছে, বিল্ডিংয়ে উঠে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে একজন গুলি করলো কয়েক রাউন্ড, তারপরে সে চলে যেয়ে আরেকজন এসে কয়েক রাউন্ড গুলি করলো, এটা কী! এই বর্বরতা কেন? ওর হাতেতো কোনো অস্ত্র ছিল না।”
ঢাকার কাজলা ফুট ওভার ব্রিজের কাছে আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন পুলিশ এক জায়গায় অবস্থান করছে। সেখান থেকে একজন তরুণ আহত আরেকজন তরুণকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাদেরকে লক্ষ্য করে অন্তত তিন রাউন্ড গুলি করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে আহত ব্যক্তিটি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে আর সাহায্যকারী তরুণ প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গুলি চালিয়েছে। প্রাণঘাতী বুলেটে নিরীহ পথচারি, ঘরের ভেতরে নারী-শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এবং আহত হয়েছেন।
রামপুরা থানার কাছে একটি সেলুনে গুলির ভয়াবহতার একটি চিত্র সরেজমিনে দেখেছেন বিবিসির সংবাদদাতা। সেখানে ১০ থেকে ১৫টি বুলেটের চিহ্ন দেখা গেছে। ওই ভবনে একজন নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন এবং তার সঙ্গে থাকা শিশু নাতিও গুলিবিদ্ধ হয়।
গুলিতে আহতদের অভিজ্ঞতা
এ আন্দোলনে আহত অনেকেই হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান যেটি পঙ্গু হাসপাতাল নামে বহুল পরিচিত সেখানে অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সেখানকার পরিচালক জানান, ২৭২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, যার মধ্যে ২৪৫ জনই গুলিতে আহত। হাসপাতালটির পরিচালক ডাঃ কাজী শামীম উজজামান জানান, বুধবার (৩১ শে জুলাই) পর্যন্ত তার হাসপাতালে ৭২ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং তারা সবাই গুলিতে আহত।
এছাড়া এ আন্দোলনে গুলিতে আহত ছয় জনের হাত অথবা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। “গুলি একদিক থেকে ঢুকে আরেকদিকে বেরিয়ে গেছে। হাত পা না কেটে ফেললে তাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তো।”
এসব কী ধরনের গুলি – এ প্রশ্নে মি. শামীম বলেন, “বুলেট তো আর ওখানে ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুলেট আসছে, চলে গেছে ভিতর দিয়ে। টিস্যু ভেদ করে চলে গেছে।”
গুরুতর আহতদের অধিকাংশই প্রাণঘাতী বুলেটে বিদ্ধ হয়েছেন বলেই জানান চিকিৎসকরা। কোটা আন্দোলনে সহিংসতা ও গুলিতে আহতদের ওয়ার্ডে গিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় বিবিসির সংবাদদাতার।
তাদের মধ্যে ঢাকা কলেজের একজন ছাত্র জানান, রায়েরবাগ এলাকায় শুক্রবার মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হবার পর তার পায়ে এসে গুলি লেগেছে। কিন্তু কোন দিক থেকে এই গুলি এসেছে সেটি দেখা যায়নি, ধারণাও করতে পারেননি।
আব্দুল্লাহ আল ইমরান নামের এই ছাত্র বলেন, তখন সেখানে কোনো আন্দোলন ছিল না। আমরা দেখি নাই। “আমি প্রথম বুঝি নাই যে আমার গুলি লাগছে। মুসল্লীরা আমারে ধরে আল্লাহ আল্লাহ করতেছে। আমাকে ১৩ ব্যাগ রক্ত দিতে হইছে। ছররা গুলিও না, পিস্তলের গুলিও না।”
“এখানে আপনি থাকতে পারতেন, আপনার সন্তান থাকতে পারতো, আপনার বাবা থাকতে পারতো। আমার পায়ের ভিতরে সবগুলো পঁচে গেছে। এখন হাড় ছাড়া কিছুই নাই। হাড়গুলো গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে,” বলেন এই তরুণ।
রংপুরে আহত একজন পেশাজীবী লিওনুর ইসলাম লিওন অভিযোগ করেন, তার বাড়ীর কাছেই পুলিশ তাকে গুলি করেছে। শুক্রবার বোনের বিয়ের জন্য তিনি ময়মসিংহ থেকে রংপুরে গিয়েছিলেন।
আন্দোলনের সময় এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থী কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিচ্ছে দেখে তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন, তখন তার পায়ে গুলি করা হয়। “পিকটিং হিসেবে দৌঁড়াইও নাই, পালাইও নাই। আমি জাস্ট সামনাসামনি কথা বলতেছি। পিছন থেকে একজন বলতেছে স্যার ও লিডার হইতে পারে। বলেই “আমার পায়ে গান (বন্দুক) লাগায়ে শ্যুট করছে”।
বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন থেকে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন এবং আনসার সকল বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। এই আন্দোলনের সময় ব্যাপকভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে।
কেউ কেউ গুলি হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন, তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে গুলি হয়নি বলে দাবি করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হতাহত আর গুলির ভয়াবহতা এবং বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষকরা বলছেন বিভিন্ন বাহিনী আন্দোলন দমনে টিয়ার গ্যাস, ছররা গুলি এবং শটগানের পাশাপাশি প্রাণঘাতী অস্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করেছেন।
গুলির ব্যবহার নিয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এটি মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। এটি কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা দেখেছি এইসব অস্ত্রের ব্যবহার।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এইরকমভাবে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে পারে এটা তিনি চিন্তাও করতেও পারেন না। “আনথিংকেবল। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি এই পুলিশ চিনি না।”
এ ব্যাপারে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “কী বলবো! আমিতো সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছি, মোটামুটি একটা যুদ্ধ দেখেছি, একটা ইনসারজেন্সি অপারেশনে ছিলাম বেশ কয়েক বছর।”
“এরকম হেলিকপ্টার দিয়ে এরকম অপারেশন চালাতে আমি দেখিনি। কাকে মেরেছিল। বলে আমরা টিয়ারগ্যাস মারছি, সাউন্ড গ্রেনেড মারছি, কেন হেলিকপ্টার দিয়ে মারতে হবে?” তিনি প্রশ্ন তোলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যা বললেন
সরকারি হিসেবে এই আন্দোলন ও সহিংসতায় ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার অর্থাৎ ৩০শে জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ব্রিফিংয়ে বিবিসির তরফ থেকে প্রশ্ন করা হয়, এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কেন? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বাধ্য হয়ে পুলিশকে গুলি করতে হয়েছে।
এসময় তিনি সেতু ভবন, বিটিভি ভবনে হামলা, নরসিংদীর কারাগার লুট এবং পুলিশের ওপর হামলা ও সহিংসতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের সবাই অনেক ধৈর্য্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন। যেখানে না পেরেছে সেখানে জীবন রক্ষার জন্য সম্পদ রক্ষার জন্য, দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য এই গুলি করতে বাধ্য হয়েছে।”
আন্দোলন দমনে মোট কত রাউন্ড গুলির ব্যবহার হয়েছে – এ প্রশ্নের উত্তরে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব দেননি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তিনি বলেন, “এই সবগুলো হিসাব নিকাশ আমাদের উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা রাখেন এবং এখানে কোনো একটি গুলি, কোনো একটি মৃত্যু যদি অনাকাঙ্খিত হয়, তাহলে সেজন্য তাদেরকে একটা ইনকোয়ারি হয়, সেগুলো হবে ইনশাআল্লাহ।”
আপনার মতামত জানানঃ