আবু বকর আল–বাগদাদি নামটি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ প্রথম জানতে পেরেছিল। ওই সময় ইরাক থেকে তিনি নিজেকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই সন্ত্রাসী সংগঠনটিই জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা আইসিস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী নিষ্ঠুরতা আর আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন আল–বাগদাদি।
আতঙ্ক ছড়ালেও মাত্র ৪৮ বছর বয়সে বাগদাদি মারা যান। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্র। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শীর্ষ নেতা আল–বাগদাদি মার্কিন সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন বলে ঘোষণা দেন ওই সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সিরিয়ায় ইদলিব প্রদেশে মার্কিন বাহিনীর হামলার সময় বাগদাদি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে তিন শিশুসন্তানসহ নিহত হন বলে ঘোষণা করে মার্কিন সরকার।
আবু বকর আল–বাগদাদি সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি আইএসকে একটি বৈশ্বিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যারা যুক্তরাজ্যের সমান আয়তনের এলাকা দখল করেছিল এবং পশ্চিমা দেশগুলোয় ভয়ংকর আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল।
আল-বাগদাদি হিসেবে পরিচিত হলেও এটা তাঁর প্রকৃত নাম নয়। তাঁর আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ আল-বদরি। ১৯৭১ সালে ২৮ জুলাই ইরাকের সামারার কাছে একটি সুন্নি পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, আইএসকে তিনি ৩৬টির বেশি দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী’ তালিকায় নাম ওঠে তাঁর। তাঁকে ধরিয়ে দিতে মার্কিন সরকার আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পুরস্কার ঘোষণা করে। দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়াদজুড়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাঁকে ধরার চেষ্টা চালান। ২০১৯ সালে গিয়ে মার্কিন গোয়েন্দারা তাঁর অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে এক দশকের বেশি সময় ধরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন বাগদাদি। নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাতেও তিনি কঠোর গোপনীয়তা আর নিরাপত্তাব্যবস্থা বজায় রাখতেন।
আল-বাগদাদির ঘনিষ্ঠ ইরাকি কারাগারে বন্দী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইসমাইল আল-ইথাওয়ি বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে হাতঘড়িও খুলে যেতে হতো। এর বাইরে যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র, মুঠোফোন বা ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় হলে তাঁদের চোখ বেঁধে নির্দিষ্ট স্থানে নেওয়া হতো। শুরুতে বাসে করে একস্থান থেকে অপরিচিত কোনো স্থানে নেওয়া হতো। এরপর তাঁরা চোখ খুলে সামনে বাগদাদিকে দেখতে পেতেন।
ইসমাইল আল-ইথাওয়ি বলেন, কোনো ভবনে আল–বাগদাদির সঙ্গে দেখা হলে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের বৈঠক হতো। এরপর আইএসপ্রধান ওই ভবন আগে ছাড়তেন। তিনি চলে যাওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা কড়া পাহারায় থাকার পর অন্যরা যেতে পারতেন। এরপর আবার তাঁদের চোখ বেঁধে ফেরত পাঠানো হতো। পাঁচ বছরে বড়জোর তিন থেকে চারবার আল–বাগদাদির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান ইসমাইল।
ইরাকি জয়েন্ট অপারেশন কমান্ডের মুখপাত্র জেনারেল ইয়াহিয়া রসুল বলেন, ‘কেউ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন কি না, তা নিয়ে বাগদাদির উদ্বেগ ছিল। তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। ২০১৪ সালে আল-বাগদাদির অনুসারীরা ইরাকের এক–তৃতীয়াংশ ও সিরিয়ার অর্ধেক এলাকাজুড়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে আল-বাগদাদি সম্পর্কে বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে।’
আইএস মূলত আরেক জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদা থেকে ভেঙে আসা একটি অংশ। ইরাকের আল–কায়েদার সদস্য ছিলেন আল-বাগদাদি। পরে এ সংগঠন থেকে নিজেই গড়ে তোলেন বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো জঙ্গি সংগঠন দায়েশ বা আইসিসি বা আইএস। তাঁদের আদর্শ ছিল খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনেরও একই ইচ্ছা ছিল। তবে তাঁদের মতের মিল ছিল না।
ওসামা বিন লাদেন খেলাফতের স্বপ্ন দেখলেও কখনো প্রকাশ্যে তার ঘোষণা দিতে পারেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, এ ধরনের ঘোষণা দিলে ব্যাপক সামরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। কিন্তু বাগদাদি ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের। তিনি আল–কায়েদা থেকে সরে আসেন এবং নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলে খেলাফতের ঘোষণা দেন।
আল–বাগদাদির সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। তাঁর খেলাফতের অধীন বিশ্বজুড়ে হাজারো অনুসারী তৈরি করা হয়। এসব অনুসারীর অনেকেই খেলাফতের অংশ হতে সিরিয়ায় ছুটে যান। ২০১৪ সালের পর শুরু হয় আইএসের উত্থান। চারদিকে আইএসের কালো পতাকা উড়তে শুরু করে। এর মধ্যে ছিল ইরাকের মসুল শহর। এ শহরে ১৪ লাখ মানুষ বসবাস করে থাকে। এ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর শুরু হয় আইএসের বিস্তৃতি। এ সময় আল–বাগদাদির সাম্রাজ্য পূর্বে নাইনভে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ শহরে তারা বোমা বানানোর কারখানা বানায়।
উত্তরে সিনজার পর্বত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে আল-বাগদাদির ‘খেলাফতের’। এ ছাড়া দক্ষিণে সিরিয়ার দেইল আল-জাউরের মতো তেল খনি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে আল–বাগদাদির সাম্রাজ্য।
বাগদাদির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি কমিটি এ খেলাফত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা মূলে ছিল। পরে তারা নিজেদের মতো করে আইনকানুন তৈরি করে। এ সময় তাদের বাহিনী আইসিস, আইএসআইএল, দায়েশ প্রভৃতি নামে পরিচিত হয়। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে কট্টর নীতিমালা প্রয়োগ শুরু করে। পাথরের আঘাতে মৃত্যু, চুরিতে হাত কেটে দেওয়া, আইএসের নীতি না মানলে মাথা কেটে ফেলার মতো নীতি আরোপ করা হয়।
আইএসের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ড সরাসরি টিভিতে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। জর্ডানের এক পাইলটকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য সম্প্রচার করা হয়। কারও বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হলে তাঁকে খাঁচায় বেঁধে ডুবিয়ে রাখা শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুও দৃশ্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া ট্যাংকের নিচে ফেলে মৃত্যু, কসাইয়ের মতো জবাই করে হত্যার মতো নৃশংসতা দেখানো হয়।
নৃসংশতার পাশাপাশি বাগদাদির নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্র শুরু হয়, যার কেউ কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। তারা নিজের কর সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব ধরনের কাজ শুরু করে। মধ্যযুগীয় কায়দায় খেলাফত চালানোর মতো সব ধরনের আয়োজন দেখা যায় তাদের মধ্যে। তাদের খেলাফতকে ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেটকে কাজে লাগানো শুরু হয়। খেলাফতের ভার্চ্যুয়াল বাসিন্দা হিসেবে লোকজনকে নানা প্রস্তাব দেওয়া শুরু করে। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইএসের শাখা–প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে। এই নতুন জঙ্গিদের বার্তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। বাগদাদির নির্দেশে তারা যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে প্রস্তুত। এর দায় তখন আইএসকে দেওয়ার সুযোগ ছিল তাদের। আইএসের পক্ষ থেকে ভার্চ্যুয়াল সদস্য তৈরি করে হামলায় উৎসাহ দেওয়া হতো। এভাবে তারা বিশ্বে হাজারো মানুষকে হত্যার দায় স্বীকার করে। অনেক ঘটনায় হামলাকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বা ভিডিও দিতে আল-বাগদাদির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশংসা করে।
২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে কাউন্টার টেররিজমের জ্যেষ্ঠ পরিচালক জশুয়া গেল্টজার বলেন, আইসিসের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কেন্দ্রে ছিলেন বাগদাদি। তিনি এটা এমনভাবে করতেন, যা বিশ্বের দুর্বল ব্যক্তিদের চমক দিত। তিনি এ জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও বিবর্তনে একক ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন।
মধ্য ইরাকের আল জাল্লাম গ্রামে খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম আবু বকর আল-বাগদাদির। তাঁর নাম ছিল ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আলি আল-বদরি। তিনি ছিলেন পাঁচ ভাই ও কয়েক বোনের মধ্যে একজন। তাঁর বাবা ভেড়া বিক্রি করতেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের পরিবারকে গড়পড়তা বলে থাকেন। যে এলাকায় আল–বাগদাদির জন্ম, সেটিও খুব উন্নত এলাকা নয়। স্কুলজীবন শুরু করার আগেই তাঁর পরিবার নিকটস্থ সামারাহ শহরে চলে যায়। সেখানে আল-বাগদাদির লেখাপড়া শুরু। যদিও খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না তিনি। হাইস্কুলে তিনি গণিতে মাত্র ৫০ পেয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
আল-বাগদাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন ১৭ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস। তাঁরা আল–বাগদাদিকে লাজুক, একাকী, শান্ত ও অন্তর্মুখী বলে বর্ণনা করেন। এসব সাক্ষাৎকারদাতার বর্ণনা অনুযায়ী, বাগদাদি একসময় অতি রক্ষণশীল হয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালে ২০ বছর বয়সে তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে স্নাতক শেষ করে সাদ্দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি।
লেখাপড়ার খরচ জোগাতে বাগদাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতেন আল–বাগদাদি। তাঁকে শিক্ষার্থীরা শেখ ইব্রাহিম নামে চিনতেন। ছাত্রদের কাছে তিনি অনেকটাই স্বল্পভাষী ও অন্তর্মুখী ছিলেন। তাই ছাত্ররা তাঁকে পছন্দ করতেন। তিনি অনেকটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করতেন। ২০০৩ সালে বাগদাদের আকাশে মার্কিন যুদ্ধবিমান উড়তে শুরু করে। সাদ্দাম হোসেনের সরকারের পতন দেখে আল-বাগদাদি বাগদাদ ছেড়ে নিজ শহরে চলে যান।
আল-বাগদাদি একবার একটি ফুটবল দলের সদস্যদের কোচিং করিয়েছিলেন। সেই দলের সদস্য ফয়সাল গাজী তাইয়াহ পরে বলেন, আল-বাগদাদি বাগদাদ শহর ছাড়ার এক বছর পর তিনি টিভিতে একদল বন্দীকে দেখতে পান, যার মধ্যে তিনি আল–বাগদাদিকেও দেখেন। ওই সময় তাঁদের কমলা রঙের পোশাক পরিয়ে রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আইএসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের এ পোশাক পরিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করত আইএস।
ইরাকের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানান, আল-বাগদাদি ২০০৪ সালে ফালুজাতে এক আত্মীয়র বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। ওই সময় আল-বাগদাদির এক ভগ্নিপতিকে গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান চালিয়েছিল মার্কিন সেনারা। ওই সময় আল-বাগদাদিকে গ্রেপ্তার করে তাঁরা। পেন্টাগনের নথি অনুযায়ী, তাঁকে ১১ মাস ক্যাম্প বুকার বন্দিশিবিরে রাখা হয়।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, মার্কিন ওই বন্দিশিবির থেকেই আল-বাগদাদি উগ্রবাদী হয়ে ওঠেন। অবশ্য তাঁর সঙ্গে বন্দিশিবিরে থাকা অনেকেই বলেন, বন্দিশিবিরে আসার আগে থেকেই তিনি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
আল-বাগদাদির সঙ্গে আল-বুকা বন্দিশিবিরে থাকা তালিব আল-মায়াহি বলেন, আল-বাগদাদি যখন গ্রেপ্তার হয়ে বন্দিশিবিরে আসেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩০। ওই বন্দিশিবিরে থাকা বন্দীরা পরে সংগঠিত হতে শুরু করেন। প্রতিটি শিবিরে একজন করে ‘আমির’ নিয়োগ করা শুরু হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন আল-বাগদাদি। তিনি তাঁবু থেকে শিয়া বন্দীদের তাড়ানোর কাজ শুরু করেন এবং সুন্নি বন্দীদের নিয়ে দল তৈরি করেন।
ইরাকে সুন্নী ও শিয়াদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। ওই সময় শিয়াদের প্রতি ঘৃণা ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছিল। শিয়াদের প্রার্থনার স্থানগুলো তখন সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। আল–বাগদাদির সন্ত্রাসী বাহিনী এ কাজে অগ্রগামী ছিল। আল–কায়েদা ভেঙে এসে আইএসের অনুসারী দ্রুত বাড়তে থাকে।
পেন্টাগনের রেকর্ড অনুযায়ী, আল-বাগদাদি ২০০৪ সালের শেষ দিকে ছাড়া পান। এটা মার্কিন কর্মকর্তারা তাঁদের গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে স্বীকার করেন। এক দশক পর পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কে বলতে পারত, আমাদের কাছে যে একদিন গ্রেপ্তার হয়েছিল, সে একসময় আইএসের প্রধান হবে।’
মার্কিন বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘদিন আড়ালে ছিলেন আল-বাগদাদি। এরপর ২০০৯ সালে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী একটি জঙ্গি আস্তানা কিছু গোপন নথি উদ্ধার করে। সেখানে আবু দুয়া নামে একজনের নাম পাওয়া যায়। শুরুতে জঙ্গিদের মধ্যে তার কার্যক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল। ইরাকি গোয়েন্দাপ্রধান আবু আলি আল-বশরী বলেন, নথি উদ্ধারের কয়েক মাস পরে জঙ্গিদের এক শীর্ষ নেতাকে নিরাপত্তা সদস্যরা আটক করে। ২০১০ সালের মার্চে বাগদাদের এক চেকপয়েন্টে ইরাকি গোয়েন্দারা মানাফ আল-রাউয়ি নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন ব্যবসায়ী নিক ব্রেগকে হত্যার অভিযোগ ছিল। ইন্টারনেটে তাঁকে হত্যার ভিডিও প্রচার করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে আবু দুয়ার নাম জানা যায়।
ওই সময় আবু দুয়া জঙ্গিদের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলেন। এরপর ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন আল-বশরী। তাঁরা তিনজনের নাম জানতে পারেন। তাঁদের একজন ছিলেন আল-বাগদাদি। এরপর ২০২০ সালের মে মাসে ওই নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের নতুন নেতার নাম আবু দুয়া বলে ঘোষণা দেয়। এ আবু দুয়াই হলেন আবু বকর আল-বাগদাদি।
আবু দুয়াকে শনাক্তের পর তাঁকে ধরতে অনেক গোপন অভিযান চালায় ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকি গোয়েন্দারা তিন বছর তাঁর পিছু লেগে থাকেন। এর মধ্যে কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে রক্ষা পান আল–বাগদাদি। এর পর থেকে তিনি সতর্ক হয়ে যান। নিকটজনকেও তিনি আর বিশ্বাস করতেন না।
২০১৪ সালে মসুলে আল–বাগদাদি যখন খেলাফত ঘোষণা দেন, তখন তাঁর চেহারা দেখতে পায় বিশ্ববাসী। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ধরতে অভিযান চালাতে থাকে। মার্কিন গণমাধ্যমে অনেকবার তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু বারবার অডিও, ভিডিওতে নানাভাবে হাজির হয়ে আল–বাগদাদি সেখবর খবর ভুয়া বলে প্রমাণ করেন। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে। পরে ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করে, তাঁদের অভিযানের মুখে ২৭ অক্টোবর আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছেন বিশ্বজুড়ে ত্রাস হয়ে ওঠা আল-বাগদাদি।
আপনার মতামত জানানঃ