আমাদের এই উপমহাদেশের মাটিতে সর্বপ্রথম সভ্যতার ঝাণ্ডা গেড়েছিল কারা? প্রশ্নটির বেশিরভাগ উত্তরই হয়তো হবে হরপ্পা সভ্যতার লোকেরা। কথাটি পুরোপুরি উড়িয়েও দেওয়া যায় না, কারণ প্রাচীন ভারতবর্ষীয় সভ্যতার ইতিহাসে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো; দুটি নামই জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তাই অনেকের ধারণা- হরপ্পা নগরীর মাধ্যমেই এই উপমহাদেশে প্রাচীন সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। এটাও ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যদিও তা বেশ পরের ঘটনা।
বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতেই ফিরে যেতে হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে। তখনই সর্বপ্রথম কৃষিকাজের সূচনা হয় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক উর্বর ভূমিতে। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মানবসভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে পাল্টে যায় মানুষের চিরাচরিত জীবন অভ্যাস। প্রাচীন প্রস্তর যুগে পশু শিকার মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন হলেও নব্যপ্রস্তরযুগীয় বিপ্লব ঘটার ফলে মানুষ ঝুঁকে পড়ে কৃষিকাজের দিকে। এর আগে শিকার ধরার জন্য যাযাবরের মতো পৃথিবী চষে বেড়ালেও, কৃষিকাজের তাগিদে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের প্রয়োজন পড়ে। নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের ফলেই সেটা থেকে একসময় গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ জাতি-গোষ্ঠীর। যারা উদ্ভাবনী শক্তির রঙে রাঙিয়েছে প্রাচীন সভ্যতার ধুলোমাখা পথ, যারা সুসংহত সভ্যতার সব্যসাচী রূপকার। পশু শিকার ছেড়ে কৃষিকাজ শুরু করলেও প্রস্তর যুগের সেই পাথুরে সরঞ্জামাদির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি, বরং শুরু হয় সেগুলোর নিত্যনতুন ব্যবহার। ওই নব্যপ্রস্তরযুগেই, আজ থেকে প্রায় নয় হাজার বছর আগে সিন্ধু উপত্যকার পশ্চিমে গড়ে ওঠে এক গ্রামীণ সভ্যতা, যাকে ‘মেহেরগড় সভ্যতা’ নামে অভিহিত করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে শুরু হয়ে এই সভ্যতা পৃথিবীর বুকে টিকে ছিল মোটামুটি ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। অনেকের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার খ্যাতিটা হয়ত ‘হরপ্পা সভ্যতা’র গায়ে সেঁটে দেয়া আছে। কিন্তু হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছে এই মেহেরগড় সভ্যতার উপর ভিত্তি করেই। এটি বর্তমানে পাকিস্তানের কোয়েটা, কালাত, সিবি শহরের মধ্যে এবং বোলান গিরিখাতের নিকটে অবস্থিত।
হাজার বছর পর এই অজানা সভ্যতার কথা পৃথিবীর সামনে উঠে আসে ফরাসি স্বামী-স্ত্রী জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও ক্যাথরিন জারিজ পরিচালিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দলের মাধ্যমে। তারা পাকিস্তানে আসেন প্রাচীন বসতির খোঁজে। কিন্তু তারা পেয়ে গেলেন এক মিসিং লিংকের সন্ধান! যে মিসিং লিংক উদঘাটন করে দিয়েছে হরপ্পা সভ্যতার আদি রহস্য। ১৯৭৪ সালে বেলুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকার কাচ্চি সমভূমিতে তারা এই সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার করেন। বেলুচিস্তানের ঝোব নদীর দক্ষিণ উপত্যকা থেকে সিন্ধু নদের সমগ্র পশ্চিম অংশ পর্যন্ত এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। ১৯৭৪ সালে তারা এই স্থান আবিষ্কারের পর ‘আর্কিওলজিকাল সার্ভে অভ পাকিস্তান’ এর সাথে মিলে, ১৯৭৫-১৬ সাল পর্যন্ত একটানা কাজ করে যান। ১৯৮৭-৯৫ সাল পর্যন্ত তারা মনোনিবেশ করেন ‘নাউশারো’ নামক এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে। এরপর ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে মেহেরগড় সভ্যতার আদ্যোপান্ত জানার উদ্দেশ্যে খননকাজে হাত লাগান তারা।
মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে এখন পর্যন্ত মোট ছয়টি টিলা আবিষ্কার করা গেছে। এই টিলা থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংখ্যা ৩২,০০০ এরও অধিক। ৪৯৫ একর ক্ষেত্রফলের প্রাচীন এই সভ্যতার গোড়াপত্তন ঠিক কোন জায়গা থেকে হয়েছিল, তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে ওই স্থানের উত্তর-পূর্ব কোণের ছোট্ট কৃষিনির্ভর গ্রামকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সভ্যতার পথচলা।
গবেষকেরা এই সভ্যতার পর্যায়কালকে মোট ৭টি স্তরে বিভক্ত করেছেন। যার মধ্যে প্রথম তিনটিকে নব্যপ্রস্তরযুগের এবং বাকি চারটিকে তাম্র-যুগের বলে অভিহিত করা হয়। এই সাতটি স্তরে, ভ্রাম্যমাণ পশুপালকের জীবন থেকে শুরু করে নাগরিকতায় উত্তরণের প্রতিটি দশার সুস্পষ্ট বিবরণ বিদ্যমান।
মেহেরগড় সভ্যতার প্রথম পর্যায়ের সময় ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭,০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫,৫০০ অব্দ পর্যন্ত। বলা যায়, এটি ছিল নব্যপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়। এই জায়গায় কৃষিব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে গম ও যব চাষ করা কিছু অর্ধ-যাযাবর জাতির লোকের মাধ্যমে। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা গবাদিপশু পালনও শুরু করেছিল। প্রথমে এলাকাটি ছিল শিকারি ও ভ্রাম্যমাণ পশুপালনের এক অস্থায়ী আবাসস্থল। পরবর্তীতে কৃষিভিত্তিক চর্চার বিকাশ ঘটার মাধ্যমেই এখানে স্থায়ী আবাস গড়ে ওঠে। মেহেরগড়ের উর্বর জমি আর চমৎকার আবহাওয়া ওখানকার জীবন অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল।
ঐসময় পশুপালনকে অধিক গুরুত্ব দেয়ায়, গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ভেড়া, ছাগল এবং ষাঁড় ছিল অন্যতম। শিকার ধরার জন্য ওরা কুকুরকেও গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করেছিল। বনের মধ্যে থাকা কিছু প্রাণী এসেছিল মানুষের সাহচর্যে। কৃষিজমিতে জলসেচের জন্য জলাধারে ছোট ছোট ছোট বাঁধ দেয়া হত। কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য শস্যাগার নির্মাণের প্রচলন ছিল সেসময়। এই সভ্যতায় কৃষির বিকাশ লাভ করার পরেই পশুপালনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। কৃষিজ শস্য বহন এবং খাদ্যের জন্যই মেহেরগড়বাসী পশুপালন করত। এছাড়া পশু শিকারও ছিল তাদের অন্যতম জীবিকা।
ঐসময় অধিকাংশ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হতো কাদামাটির সাহায্যে। কাদামাটি দিয়ে তারা সমান মাপের ইট তৈরি করত। বাড়িগুলো ছিল একাধিক কামরায় বিভক্ত। প্রথমদিকে মেহেরগড়বাসীরা বহু কামরা বিশিষ্ট কক্ষে বাস করতেন, যেগুলোর কোনো দরজা ছিল না। যাতায়াতের পথ ছিল ছাদ। যার সাথে বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, নব্যপ্রস্তরযুগীয় তুরস্কের কাতাল হুয়ুকের বাড়িগুলোর। ঘর উষ্ণ রাখার উদ্দেশ্য অনেক বাড়িতে আগুন জ্বালানো ব্যবস্থা ছিল, যা বর্তমানের ফায়ার প্লেসের সাথে তুলনা করা যায়।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখানে বেশ কিছু সমাধির হদিস পেয়েছেন। অবাক করা বিষয় হলো, এর ভেতরে সন্ধান মিলেছে ঝুড়ি, জপমালা, কানের দুল, হাড়ের সরঞ্জাম, নীলকান্তমণি, একপৃষ্ঠীয় প্রস্তর কুঠার ইত্যাদি। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে বলি দেওয়া পশুর কঙ্কাল। অর্থাৎ ওই সভ্যতার শুরুর দিকে বলি প্রথা চালু ছিল। সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান। ঝিনুকের খোল, চুনাপাথর, যাঁতা, হামানদিস্তা, নিড়ানি, কাস্তে, এবং বেলেপাথরে অলঙ্কারের সন্ধানও মিলেছে। সিন্ধু সভ্যতার মতো বিভিন্ন প্রাণী ও মানবমূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। গবেষকদের মতে, এই মূর্তিগুলো ভারতীয় ভাস্কর্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।
কৃষি-যন্ত্রপাতির মধ্যে প্রাপ্ত প্রাচীনতম হাতিয়ার হলো বিটুমিন জাতীয় পাথরখণ্ড দ্বারা নির্মিত কাস্তে। তাছাড়া পাথরের নির্মিত কিলনোরা, যাঁতা, হামানদিস্তা, নিড়ানি ও অন্যান্য পাথরের যন্ত্রপাতিও সেই আমলে ব্যবহার করত মেহেরগড়ের বাসিন্দারা।
.
মেহেরগড়ের সাথে যে দূরবর্তী দেশসমূহের বহির্বাণিজ্য চালু ছিল, সে ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কারণ, প্রত্নসম্পদের মধ্যে প্রচুর সামুদ্রিক ঝিনুক খুঁজে পাওয়া গেছে, যা মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকেই এখানে আসা সম্ভব। কালক্রমে এই মেহেরগড়েই থিতু হতে চেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই সভ্যতা। তাই গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার বলয় থেকে বের হয়ে মেহেরগড় ধীরে ধীরে নগরায়নের পথে অগ্রসর হতে শুরু করে।
মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়সীমা ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ে চলতি কৃষিকাজ এবং পশুপালনের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের পরিবর্তন প্রয়াসী মনোভাবের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন বেশ কিছু সংস্কার ও নতুনত্ব চোখে পড়ে।
এই পর্যায়ের প্রচুর কার্পাস তুলোর বীজের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করা গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, তখনকার মানুষ কার্পাস চাষ করতে জানত। এটিই ভারতবর্ষের তুলো চাষের প্রাচীনতম নিদর্শন। অনুমান করা হয়, এই কার্পাস তুলো দিয়ে তৈরি করা সুতো দিয়ে তারা কাপড় বানাত। বিষয়টি মোটা দাগে এটাও চিহ্নিত করে যে, হরপ্পা সভ্যতার দু’হাজার বছর আগেই মেহেরগড় সভ্যতায় তুলাের চাষ শুরু হয়।
মেহেরগড়বাসীরা ইতিহাস সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তাদের কুমোর শিল্প দ্বারা। এদিক থেকে তাদের দক্ষতা যে প্রশ্নাতীত, তা বলাই বাহুল্য। তৎকালীন সভ্যতার সুনজর যায় মৃৎশিল্পের দিকে। এজন্য অবশ্য ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল কুমোরের চাকা, যার আগমন ঘটে সুদূর সুমের সভ্যতা থেকে। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে, অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষভাগে জোয়ার আসে এঁটেল মাটির তৈরি দ্রব্যসামগ্রীর নান্দনিক শিল্পকর্মে। চাকা আসার আগে অবশ্য মাটির পাত্রগুলো হাতে তৈরি করা হতো হাত দিয়ে। চাকা আসার পরেই মৃৎশিল্পে একপ্রকার বিপ্লব চলে আসে। মৃৎপাত্রগুলো শক্ত ও টেকসই করার জন্য চুল্লির আগুনে পোড়াত ও তাতে রঙ-বেরঙের প্রলেপ দিত। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য পাত্র ছাড়াও এই সভ্যতার মানুষ নারীমূর্তি, গবাদিপশুর মূর্তি ও খেলনা মাটি দিয়ে বানাত।
তখন প্রচুর পরিমাণে গম, বার্লি এবং তুলোর চাষ হতো। এই বিষয় থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হওয়া যায়, তা হলো- তখনকার মানুষ তৎকালীন সভ্যতায় সেচব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল। প্রথম পর্যায়ের মতো দ্বিতীয় পর্যায়েও পশুপালন এবং বহির্বাণিজ্য তখনো বহাল ছিল। মৃতদেহের উপরে লাল মাটির সন্ধানও মিলেছে। সময়ের সাথে সাথে যেমন লাশের সংখ্যা কমেছে, তেমনি ক্ষয় হয়ে গিয়েছে মৃতদেহের সাথে দিয়ে দেওয়া অলংকার।
পর্যায় এক, দুইয়ের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ‘কিলি গুল মুহাম্মদ’ এর সাথে। মেহেরগড় সভ্যতা মৃৎশিল্পের সাথে পরিচিত হবার আগপর্যন্ত সময়কালকে অনেকসময় ‘কিলি গুল মুহাম্মদ পর্যায়’ বলে অভিহিত করা হয়। কিলি গুল মুহাম্মদে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ অব্দতে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত বহাল ছিল এই সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়। এই পর্যায়ে কৃষিক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতির ধারা লক্ষ্য করা যায়। কারণ, প্রত্নসম্পদে কর্ষিত শস্যের বিরাট তালিকার খোঁজ পাওয়া গেছে। এই সময়ে নব্যপ্রস্তর যুগের পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে মেহেরগড় সভ্যতা পদার্পণ করে তাম্র-যুগে। নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। নব্য-প্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে। তবে পাথরের ব্যবহার ও গুরুত্ব তখনও অব্যাহত ছিল। তাই এই যুগকে তাম্র-প্রস্তর যুগও বলা হয়। ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত তামার পুঁথি থেকে মনে করা হয় এই সভ্যতার মানুষ তামা গলানোর প্রক্রিয়া আয়ত্ত করতে পেরেছিল। তামার আকরিক থেকে তারা বিভিন্ন সাজসজ্জার অলংকার তৈরি করত। তৃতীয় পর্যায়ে অন্তত ১৪টি পাত্রের সন্ধান মিলেছে, যেগুলো তামা গলানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্যায় থেকেই যে তামার ব্যাপক ব্যবহারের সূচনা ঘটেছে, এই পাত্রগুলো তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এছাড়াও এই পর্যায়ে পাওয়া গেছে তামার ছুরি, বড়শি, সূচ, তামার সিলমোহর প্রভৃতি। তামার সিলমোহর দ্বারা বণিকরা নিজেদের পণ্য চিহ্নিতকরণের কাজ করত। ৬০০০ বছরের পুরনো চাকা আকৃতির একটি তাম্র মাদুলি পাওয়া গেছে মেহেরগড়ে। ওই মাদুলি তৈরি করা হয়েছিল খাঁটি তামা থেকে। সভ্যতার বিকাশ, উন্নতি ও বিস্তারের সাথে সাথে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক হয়ে উঠে আগের থেকে আরও বিস্তৃত।
মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতির ছোঁয়া দেখা যায় বহুলাংশে। ওই সময়ের মৃৎপাত্রগুলোতে নানাপ্রকার জ্যামিতিক নকশা, পশু-পাখি, গবাদি পশু এবং গাছপালার ছবির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা সভ্যতার উত্তরোত্তর অভ্যুত্থানকেই নির্দেশ করে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন চীনামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে মেহেরগড়ে। সভ্যতার প্রথম দিকে তৈরি করা মূর্তিগুলো ছিল শিল্পচাতুর্যহীন, এবং সাদাসিধে রকমের। সময়ের সাথে সাথে মৃৎশিল্পে বাহারি ধরন যোগ হতে থাকে। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে চুলের ধরনে আসে বৈচিত্র, সেগুলো বেণী পাকানো থাকে। মূর্তিগুলোর স্তনের আকার বড় হবার পাশাপাশি সম্মুখদিকে প্রলম্বিত হয়ে যায়। অনেক নারী মূর্তিকে কোলে শিশু ধরে রাখতে দেখা গেছে, যাকে ‘মাদার গডেস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ পর্যন্ত ছিল চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ের বিস্তৃতি-কাল। এই সকল পর্যায়ে এসে সভ্যতা তার চূড়ান্ত উৎকর্ষে উপনীত এবং পরিণত হতে থাকে। আগের পর্যায়গুলো সাধারণ মৃৎপাত্র তৈরি করা হলেও এই পর্যায়ে তা নির্মাণে আসে নানা বৈচিত্র্য। সময় যত বাড়তে থাকে, মাটির তৈজসপত্রের উপরের ত্রিভুজ-রেখার নকশাগুলো পরিবর্তিত হয় পশু-পাখির দিকে। বৈচিত্র্যময় কারুকার্যের সাথে টেক্কা দিয়ে নানা রঙের ব্যবহারও দেখা যায়, যা তাদের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও মনোভাবের পরিচায়ক। মাটির তৈজসপত্রের উপর সুদৃশ্য নকশার সাথে তারা যোগ করত সামান্য জ্যামিতিক জ্ঞান। তখন জলসেচের জন্য খাল কাটার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মেহেরগড়ে নগরায়নের সূচনা হয়েছিল সেই দ্বিতীয় পর্যায় তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায় পর্যন্ত তার পরিপূর্ণ প্রকাশ, বিস্তার এবং বিকাশ নজরে আসে। মানুষের জীবনযাত্রার মান, উন্নত রুচির বহিঃপ্রকাশ, রাস্তাঘাট এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অগ্রগতিতে তার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়। ষষ্ঠ পর্যায় থেকে সজ্জাকরণের বস্তু হিসেবে পিপুল গাছের পাতার ব্যবহার শুরু হয়। চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায় পর্যন্ত ছিল মেহেরগড় সভ্যতার সোনালী যুগ। এ সময় মেহেরগড় সভ্যতা ফুলে ফেঁপে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রাণচঞ্চল এবং ব্যাপক পরিসরের। চিত্রকলা এবং ভাষারও যুগপৎ পরিবর্তন ঘটে।
সমাধিগুলোতে মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া তাদের নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী- অলংকার, হাতিয়ার, নীলকান্তমণি, এবং পালিত পশুর উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে, মেহেরগড় সভ্যতায় সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের অস্তিত্ব ছিল এবং একইসাথে তারা ছিল মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী। মৃতদেহ সৎকারের আগে গেরুয়া মাটি ব্যবহার করা হতো। মৃতদেহ সমাধিস্থ করার রীতি এবং মৃতদেহের সঙ্গে দেয়া মূল্যবান সামগ্রীর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ভিত্তিতে মেহেরগড় সভ্যতার সামাজিক বৈষম্যের দিকটিই স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলে। এছাড়াও শস্য মজুদ রাখার পদ্ধতি, তাদের ব্যবহৃত হস্তশিল্পের সামগ্রী প্রভৃতির পার্থক্য থেকেও সমাজে শ্রেণীবিভাজন বা বৈষম্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই যুবতীর সমাধিক্ষেত্র থেকে বেলনাকার নীলকান্তমণির ছোট মালা উদ্ধার করা গেছে, যা এসে থাকতে পারে মেহেরগড়ের ১০০০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর বাদাকশান থেকে। আরও পাওয়া গেছে চাকতি আকৃতির একটি ঝিনুকের মালা, যা আনা হয়েছিল ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘ম্যাকরান উপকূল’ থেকে। মায়ের পেটে ভ্রূণ যে অবস্থানে থাকে, তাকে ঠিক সেভাবেই দাফন করা হয়েছিল, পশ্চিমমুখী করে। তার পায়ের কাছে ছয়টা বাচ্চা ছাগলের হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে যাতে তিনি পশুপালন করতে পারেন, সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
মেহেরগড় থেকে দুই ধরনের সমাধিক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যে সমাধিগুলোতে শুধু একজন মানুষকে সমাহিত করা হয়েছে সেগুলোকে সংকীর্ণ ও অপ্রশস্ত মাটির দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। আর যেগুলো গণকবর, সেগুলো ছিল মাটি-ইটের দেয়াল সম্মিলিত। প্রতিটি গণকবরে লাশের সংখ্যা গড়ে ছয়টি করে। গণকবরে লাশগুলো শোয়ানো হতো পূর্ব থেকে পশ্চিমে। বৃহদাকার ঘড়াতে শিশু কংকালের হাড়ের সন্ধানও মিলেছে, যা আনুমানিক ৪০০০-৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের।
২০০১ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, এই সভ্যতার লোকেরা আদি দন্তচিকিৎসা সম্পর্কে জানতো। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই গবেষণা চালিয়েছিল মূলত মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত দুজনের দেহাবশেষ নিয়ে। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ একটি আর্টিকেল পাবলিশ করা হয়, যেটাতে উল্লেখ আছে, সেই প্রারম্ভিক নব্যপ্রস্তরযুগেই মানুষের দাঁত বাঁধানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে মেহেরগড় সভ্যতায়। প্রাচীন মেহেরগড়ের এক সমাধিস্থল থেকে আবিষ্কৃত নয়জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির এগারোটি বাঁধানো দন্ত-মুকুটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা আনুমানিক ৫,৫০০ থেকে ৯,০০০ বছর আগের হতে পারে।
উপাসনালয়ের অনুপস্থিতির জন্য অধিবাসীদের ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায় না। তবে পোড়া মাটির তৈরি বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যা থেকে মাতৃপূজার বিষয়ে ধারণা করা হয়।
অনেকের ধারণা, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে মেহেরগড়বাসীরা আরও উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে কয়েক কিলোমিটার দূরের শহর ‘নাউশারো’তে চলে আসে। ফলে খালি হয় যায় মেহেরগড়, এবং ওখানেই ইতি টানে সভ্যতাটি। আবার অনেকে দায়ী করেন তৎকালীন প্রতিকূল জলবায়ুকে। ঐতিহাসিকদের অনুমান, মেহেরগড় অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় বৃষ্টিপাত কমে যায়। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির ফলে সমগ্র অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুভূমির রূপ নেওয়া শুরু করলে মেহেরগড়বাসীরা অন্যত্র সরে যায়। ফলে অঞ্চলটি জনমানবশূন্য হয়ে একসময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আবার অনেক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, বন্যা বা ভূমিকম্প এই দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে কোনো একটি মেহেরগড় সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী।
এই সভ্যতার পতন কেন ঘটেছিল, তার কারণ এখনো অস্পষ্ট। মেহেরগড়বাসীরা অজানা কোনো কারণে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে পাঞ্জাবের হাকরা নদীর উপত্যকায় এসে নতুন এক সভ্যতা নির্মাণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা হরপ্পা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায় বলে অধিকাংশ গবেষক মত প্রকাশ করেছেন।
প্রাচীন জনবসতির ব্যাপারে ভারতবর্ষের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কপালে চোখ ওঠার মতো। তামিলনাড়ুর আত্তিরামপাক্কামে চালানো এক খননকাজে ১৫ লক্ষ বছর আগের হোমো ইরেক্টাসের সন্ধান পাওয়া গেছে।
মেহেরগড়ে সভ্যতা বিকাশের পাশাপাশি, ওদিকে গঙ্গা উপত্যকাতেও একটি সভ্যতা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। এলাহাবাদের ‘ঝুসি’ অঞ্চলে ৭১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক সভ্যতার অস্তিত্বের গুঞ্জন উঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখানে খননকার্য তেমন বৃহৎ পরিসরে চালানো হয়নি। নইলে এখান থেকেও অনেক অজানা তথ্য উঠে আসতে পারত, যা পাল্টে দিতে পারত পূর্বের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস।
এতদিন সকলের ধারণা ছিল যে, সিন্ধু সভ্যতাই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা এবং হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল মেসোপটেমিয়ার দূরবর্তী উপনিবেশ। কিন্তু মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কারই সকল পুরাতন ভোল পাল্টে দিয়েছে। সিন্ধু-পূর্ব যুগেও ভারতবর্ষের মাটিতে বিকাশ ঘটেছ এক উন্নত সভ্যতার। তাই বলা যায়, সিন্ধু সভ্যতার গোড়াপত্তনকারীরা বহিরাগত নয়, বা আফ্রিকা-ইউরোপ থেকে হুট করে চলে আসেনি — তারা ছিল এই অঞ্চলেরই মানুষ। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো উন্নত নগর সভ্যতা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়— মেহেরগড় ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মানব সভ্যতার যে প্রসার ঘটেছিল, হরপ্পা সভ্যতা তারই এক পরিপূর্ণ উজ্জ্বল প্রতিফলন।
আপনার মতামত জানানঃ