এককালে পৃথিবীতে কোনো পোষা প্রাণী ছিল না। খাদ্যের জন্য মানুষ প্রাণীদের পুষতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একদল পোষা প্রাণী। বদলে যায় মানুষও। হাজার বছরের সেই ইতিহাস আজ আমরা জানব।
শহরে অনেকেই শখ করে কুকুর বা বিড়াল পোষে। তবে পোষা প্রাণীর ধারণা এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। এককালে মানুষ খাদ্যের জন্য বিভিন্ন প্রাণী পুষতে শুরু করে। এদের বলা হয় গবাদিপশু। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রাগুলোর অন্যতম এটি। সেটা আজ থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগের কথা। ইতিহাসে সময়টা ‘নিওলিথিক রেভল্যুশন’ বা ‘নিওলিথিক বিপ্লব’ নামে খ্যাত। সে সময় মানুষ ফসল ফলাতে শুরু করে। পাশাপাশি অ্যানিমেল ফার্মিং, অর্থাৎ প্রাণীর খামার করতে শুরু করে খাদ্যের জন্য। এর মূল লক্ষ্য ছিল, যেসব বন্য প্রাণীর মধ্যে ইতিবাচক ও মানুষের জন্য সুবিধাজনক গুণাবলি আছে, সেগুলো দেখে দেখে তাদের মধ্যে প্রজনন ঘটানো, অর্থাৎ কৃত্রিম প্রজনন করানো। এভাবে বাছাই করে প্রজনন করানোর মাধ্যমে মানুষ মাংস, দুধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে শুরু করে।
প্রশ্ন আসে, প্রথম কোন প্রাণীটিকে খাদ্যের জন্য পোষ মানিয়েছিল মানুষ? দেখা যায়, আজকের আধুনিক ভেড়ার পূর্বপুরুষ ছিল সেটা। এর নাম এশিয়াটিক মাফলন, বৈজ্ঞানিক নাম Ovis orientalis. সেটা প্রায় ১১ হাজার বছর আগের কথা। তারপর কালে কালে মানুষ ৩৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ৮ হাজার ৮০০ ব্রিড বা জাত চাষ করেছে। এভাবে গরু, ভেড়া, মুরগির মতো প্রাণী মোটাতাজা হয়েছে—গরু এখন বেশি দুধ দেয়, গরু-মুরগির শরীরে এখন বেশি মাংস পাওয়া যায়।
ঠিক কীভাবে মানুষ প্রাণীদের কৃত্রিম প্রজনন করাতে শুরু করল? কীভাবে পোষ মানাল তাদের? এ পদ্ধতি নিয়ে ঠিক নিশ্চিত নন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তবে তাঁদের একটা ধারণা হয়েছে সম্প্রতি। এর পেছনে আছে ২০১৪ সালে তুরস্কে পাওয়া কিছু ফসিল। প্রায় ১১ হাজার বছর আগে তুরস্কের মেলেন্দিজ নদীর তীরে ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। সেখানেই পাওয়া গেছে ইতিহাসের প্রাচীনতম কিছু গবাদিপশুর অবশেষ—বলা ভালো, হাড়গোড়। যেখানে হাড়গোড় পাওয়া গেছে, জায়গাটা আশুকলা হয়ুক (Aşıklı Höyük) নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দেখলেন, এ অঞ্চলে কালের আবর্তে হরিণ, ছাগল ইত্যাদি প্রাণীর হাড় কমে গেছে বহুলাংশে। ১১ হাজার বছর থেকে এগিয়ে সাড়ে ৯ হাজার বছর অতীতে এসে দেখা যাচ্ছে, ৯০ শতাংশ অবশেষই ভেড়ার। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ স্ত্রী ভেড়ার। বোঝাই যাচ্ছে, স্ত্রী ভেড়াদের এই প্রাবল্যের পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো, অর্থাৎ ভেড়ার খামার করা।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দেখেছেন, এসব অবশেষ পাওয়া গেছে সেই গ্রামের মাঝখানে। তাই তাঁরা ধারণা করছেন, গ্রামীণ খামার ছিল গ্রামটির ঠিক মাঝখানে। পাশাপাশি শিশু ভেড়াদের পোষ্য হিসেবে পালতে শুরু করে গ্রামবাসী। কেন? এ প্রশ্নের জবাবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, সেকালে মাংসের জন্য শিকার করতে অনেক সময় চলে যেত। ফলে ফসল ফলাতে বেশি সময় দিতে পারত না মানুষ। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই তারা শিকার করা ভেড়া (এবং অন্যান্য গ্রামে অন্য বন্য প্রাণীদের) ধরে নিয়ে আসতে শুরু করে। তাদের খাবার দিতে শুরু করে, পাশাপাশি শুরু করে কৃত্রিম প্রজনন, অর্থাৎ মানুষ বাছাই করে দেয়, কোন ভেড়া বা গরুগুলোর মধ্যে প্রজনন হবে। এভাবে মানুষ যেমন মাংসের সহজ উৎস পেল, তেমনি ফসল আবাদে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগও পেল।
পোষ মানানো ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এসব প্রাণীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য বদলে দেয় মানুষ। বদলে দেয় তাদের স্বভাব। ধীরে ধীরে বন্যতা সরে যায়, পোষ মেনে নেয় গরু, ভেড়ার মতো প্রাণী। হয়ে ওঠে মোটাতাজা, নাদুসনুদুস গবাদিপশু। এদিকে ফসল চাষ ও প্রাণীর খামার করতে গিয়ে মানুষের স্বভাবেও পরিবর্তন আসে। শিকারি মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তোলে সমাজ। সেই সমাজের প্রত্যেকের সম্পদ রক্ষার্থে সামাজিক রীতিনীতি গড়ে ওঠে, বিনিময় প্রথা তৈরি হয়—এভাবে গড়ে ওঠে সভ্যতা।
খাদ্যের জন্য ভেড়া পোষ মানানোর বিষয়টা তো বোঝা গেল। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, আমাদের দেশে তো ভেড়া নয়, গরুর খামার করার রীতিই বেশি প্রচলিত। তা এই গরু কবে থেকে পুষতে শুরু করল মানুষ? বিজ্ঞান বলছে, আধুনিক গরুর পূর্বসূরি অরোকস (Auroch) নামের প্রাণীগুলোকে মানুষ মাংসের জন্য পুষতে শুরু করে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে ডেইরি ফার্মিং, অর্থাৎ দুধের জন্য গরুর খামার করতে শুরু করেন ইউরোপীয় খামারিরা।
এসব পশুকে পোষ মানানোর প্রভাব যে শুধু সামাজিক বা বহির্গত নয়, মানুষের জিনেও যে এর প্রভাব পড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মানবশিশুর শিশুকাল পেরিয়েও দুধ খাওয়ার অভ্যাস রয়ে যাওয়া থেকে। বেশির ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী শিশুকালে মায়ের দুধ খায়। তবে কিছুটা বড় হয়ে গেলে দুধ খাওয়ার অভ্যাস ছেড়ে দেয় তারা। হয় তৃণভোজী, নয় মাংসাশী হয়ে ওঠে। এর কারণ, দুধের ল্যাকটোজ (একধরনের সুগার বা চিনিজাতীয় রাসায়নিক) হজম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এসব প্রাণী। অথচ মানুষের মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য হজমের ক্ষমতা রয়ে যায় জীবনভর। এর কারণ, দুধ খাওয়ার পর ল্যাকটোজ নামের বিশেষ একধরনের এনজাইম ল্যাকটোজ ভেঙে ফেলে, হজমে সাহায্য করে। অনেকে অবশ্য ল্যাকটোজ হজম করতে পারেন না। এর নাম ‘ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স’। এটা সেই অর্থে কোনো রোগ নয়। বিষয়টা হলো, দুধ খেলে তাদের হজমের সমস্যা হয়।
তবে অনেকে সারা জীবনই দুগ্ধজাত খাদ্য খেতে পারে। এর পেছনে রয়েছে মানুষের জিনের একধরনের মিউটেশন। এর ফলেই সেই বিশেষ এনজাইম উৎপন্ন হয় আমাদের দেহে। এই মিউটেশন ‘ল্যাকটোজ পারসিসটেন্স’ নামে পরিচিত। এই ল্যাকটোজ পারসিসটেন্সের সূচনা প্রায় ছয় হাজার বছর আগের সেই সময়ে, যখন মানুষ দুধের জন্য গরুর খামার করতে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে ল্যাকটোজ পারসিসটেন্স দেখা যায়।
প্রাণীর খামার করতে গিয়ে অগ্রগতির পাশাপাশি কিছু বিপদও ডেকে এনেছে মানুষ। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ও খামারজাত এসব প্রাণী প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। পাশাপাশি এসব গবাদিপশু থেকে কিছু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। যেমন গরু থেকে টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষ্মারোগ এসেছে মানুষের মধ্যে। সে যা–ই হোক, স্বীকার না করে উপায় নেই, এসব প্রাণীকে পোষ মানিয়ে গবাদিপশু বানানো না হলে সভ্যতা বর্তমান অবস্থায় আসত না।
আপনার মতামত জানানঃ