ইসলামে চিত্রাঙ্কনের নিষেধাজ্ঞা শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় ইতিহাস, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। প্রাথমিক ইসলামি যুগে মূর্তিপূজার বিরোধিতা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আইকনোক্লাজম বা ছবি ধ্বংস আন্দোলনের সময় মুসলিম শাসকেরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে পৃথকভাবে তুলে ধরতে চিত্রবিরোধী অবস্থানকে আরও জোরদার করেন।
৮ম ও ৯ম শতকে হাদিস সংগ্রাহকগণ এমন বহু হাদিস সংকলন করেন, যেখানে ছবি আঁকাকে কিয়ামতের দিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও অনেকে ব্যাখ্যা দেন যে এতে উদ্দেশ্য ছিল মূর্তিপূজার উদ্দেশ্যে ছবি আঁকা। এরপর আব্বাসীয় খেলাফত তাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে পারস্য প্রভাবিত শিল্পকে সীমিত করে চিত্রহীন ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলে। সালজুক ও উসমানীয় আমলেও হানাফি আইন অনুসরণ করে মসজিদে মানবচিত্র নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইসলামি শিল্প রূপ পায় জ্যামিতিক নকশা ও ক্যালিগ্রাফিতে।
আধুনিক কালে উপনিবেশবাদ ও ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ফলে চিত্রাঙ্কন আরও বিতর্কিত হয়ে ওঠে, বিশেষত সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদের প্রভাবে। ফলে, ইসলামে ছবি আঁকার নিষেধাজ্ঞা কেবল ধর্মীয় ব্যাখ্যার ফল নয়, বরং ইতিহাসের নানা বাঁকে গড়ে ওঠা একটি জটিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চা।
ইসলাম ধর্মে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনো ছবি আঁকা যাবে না—এই ধারণা আজ বিশ্বের অনেক মুসলিম সমাজে একেবারে প্রতিষ্ঠিত। অনেকেই মনে করেন, এ নিষেধাজ্ঞা ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই এসেছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইসলামি সভ্যতায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর চিত্র ছিল একটি বিশেষ ধ্যান-প্রবণ শিল্পরূপ, যা গভীর শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্মিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হতো।
প্রথমদিকে ইসলামে চিত্রকলাকে সরাসরি হারাম ঘোষণা করা হয়নি। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম যখন দ্রুত সম্প্রসারণ লাভ করছিল, তখন নতুন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে পারস্য, বাইজান্টাইন ও মধ্য এশিয়ার চিত্রকলার প্রভাব পড়ে।
১৩শ শতক থেকে পারস্য ও তুর্কি অঞ্চলে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা—যেমন তাঁর জন্ম, প্রথম ওহি, মিরাজ ও তাবুকের যুদ্ধ—দৃশ্যধর্মী চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হতো। বহু মিনিাচার পেইন্টিং বা ক্ষুদ্র শিল্পকর্মে তাঁর মুখাবয়ব স্পষ্টভাবে আঁকা হতো। এসব কাজ ছিল দরবারি পৃষ্ঠপোষকতায়, মূলত পারস্যের ইলখানিদ, তিমুরিদ ও পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায়ই তিনি মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে ছিলেন, কারণ মক্কায় কাবা ঘর ছিল মূর্তিপূজার কেন্দ্র। তিনি তাওহিদের (একত্ববাদ) প্রচারে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে কিছু সহচর তাঁর নির্দেশকে ব্যাখ্যা করে বলেন—যে কোনো জীবন্ত প্রাণীর ছবি আঁকা অনুচিত, কারণ তা মানুষকে পূজার দিকে প্ররোচিত করতে পারে।
তবে এসব ব্যাখ্যা ছিল ব্যাপকভাবে পরিস্থিতি ও ভূখণ্ডভেদে ভিন্ন। বেশিরভাগ চিত্র বিরোধী হাদিস আবু হুরায়রা বা ইবনে আব্বাসের মত সাহাবিদের বর্ণনা থেকে এসেছে—তাও বেশিরভাগই প্রাণীর বা মানুষের পূর্ণ মূর্তি বা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধাচরণ। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখাবয়ব আঁকা নিয়ে এককভাবে কোনো কোরআন আয়াত নেই।
চিত্রাঙ্কনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে পরবর্তীকালে, বিশেষ করে যখন ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলো সুন্নি ইসলামকে রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত করে। উসমানীয় ও আব্বাসীয় খেলাফত নিজ নিজ আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং শিয়া ও সুফিদের শিল্পরীতিকে প্রতিহত করতে ধর্মীয় আইনের কড়াকড়ি আরোপ করে।
সুন্নি আলেমগণ ধীরে ধীরে এমন একটি ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর চিত্রকে অপমানজনক বা শিরকপ্রবণ বলা হয়। এর মাধ্যমে তারা এক ধরনের আইকনোক্লাস্টিক (প্রতিমাবিরোধী) ইসলামি পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হন, যা ধীরে ধীরে সমাজে ধর্মীয় বিশুদ্ধতার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যদিকে, শিয়া সম্প্রদায় ও সুফি তরিকারা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ছিলেন না। ইরানে আজও নবী মুহাম্মদ (সা.), ইমাম আলী (রা.), হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর মুখাবয়ব নিয়ে চিত্রকলার প্রচলন আছে। তারা চিত্রকলাকে উপাসনা নয়, বরং স্মরণ ও ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে দেখে।
সুফিরা আবার চিত্রকলাকে ধ্যানের মাধ্যম হিসেবে দেখেন—তাদের মতে, ভালোবাসা ও ভক্তির অনুভূতি চিত্রের মধ্য দিয়েই আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠতা অর্জনের উপায় হতে পারে।
২০০৫ সালে ডেনিশ পত্রিকায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ এবং ২০১৫ সালে ফরাসি ম্যাগাজিন ‘শার্লি হেবদো’-তে চিত্র প্রকাশকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হলেও মুসলিম বিশ্বের বড় অংশ একে কটূক্তি ও ধর্মীয় আঘাত হিসেবে দেখেছে।
এই উত্তেজনার পেছনে ইতিহাস অজানা থাকার একটি বড় ভূমিকা আছে। কারণ বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না, ইসলামি ঐতিহ্যের একসময় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র ও সৌন্দর্যমণ্ডিত চিত্রকলাও ছিল—a form of visual devotion.
ইতিহাস আমাদের শেখায়, যে ধর্ম আজ কঠোরভাবে চিত্রবিরোধী হিসেবে পরিচিত, তার ভিতরে একসময় ছিল এক সমৃদ্ধ চিত্রঐতিহ্য। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিচ্ছবি এক সময় ছিল ভালোবাসা ও মহত্বের চিহ্ন। আজকের বিতর্কে ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো আলোচনায় আনা প্রয়োজন—তাতে ধর্মীয় সহনশীলতা, শিল্পের স্বাধীনতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ