বাংলাদেশের আর্থিক বাজারে সম্প্রতি ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি বেশ গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে এবং সামনে আরও কিছু ব্যাংক এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে যে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের রক্ষা করার জন্য আর্থিকভাবে সবল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তাদের একীভূতকরণ জরুরি ও কার্যকর একটি পদক্ষেপ। এই পুরো প্রক্রিয়া নীতিনির্ধারণী মহলের ইচ্ছায়ই হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এটি তদারক করছে।
ব্যাংকিং খাতে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৮০০ শতকের প্রথম ভাগেই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, যা আজ অবধি সারা বিশ্বে চলমান। ব্যাংক একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের বাজারভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাজারভিত্তিক শক্তি বা মার্কেট পাওয়ার বৃদ্ধি, ইকোনমিজ অব স্কেল বা স্কোপের সুবিধা বৃদ্ধি, বৈচিত্রায়নের মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাসকরণ ইত্যাদি।
এই সব উদ্দেশ্যে ব্যাংক অধিগ্রহণ বা একীভূতকরণের জন্য বাজারভিত্তিক নিয়ম অনুসরণ করা একান্ত অপরিহার্য। যেমন অধিগ্রহণের জন্য টার্গেট ব্যাংক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তার বাজারমূল্য বা শেয়ারমূল্য বা তার জনবলের মান, সুশাসনের মাত্রা ইত্যাদি পর্যালোচনা করা আবশ্যক।
এই সব পর্যালোচনার মাধ্যমে যদি অধিগ্রহণ বা একীভূতকরণ দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক বলে প্রতীয়মান হয়, কেবল সে ক্ষেত্রেই এমনটা করা উচিত হবে। ব্যাংক অধিগ্রহণ বা একীভূতকরণের বিষয়ে অসংখ্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসব গবেষণাপত্রের সার্বিক উপসংহার হিসেবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ স্বল্প মেয়াদে টার্গেট ব্যাংকের জন্য লাভজনক হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণালব্ধ এসব ফলাফলকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের ব্যাংক একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে বিচার–বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি বাজারভিত্তিক নয়। একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত যখন বাজারভিত্তিক না হয়, তখন তা নীতিনির্ধারকদের বা ব্যাংকগুলোর উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের ওভারকনফিডেন্স বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে হতে পারে।
নীতিনির্ধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও ব্যাংকগুলোর উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যে এর লক্ষণ আমরা ইতিমধ্যে উপলব্ধি করছি। ওভারকনফিডেন্স থিওরি অনুযায়ী অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কর্তাব্যক্তিদের নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয় যা একীভূতকরণের ফলাফলকে অতিরঞ্জিত করতে প্ররোচিত করে। সুতরাং যেসব একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে হয়, সেগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম হয়ে থাকে।
যদি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলো মন্দ ঋণ ক্রয়ে আগ্রহী হয়, তবে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেরাই এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একীভূতকরণের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি মহল একীভূতকরণের ধোয়া তুলে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ঋণখেলাপিদের বেলআউট করতে আগ্রহী। এভাবে সাধারণ জনগণের নজর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পরিণাম অর্থনীতির জন্য মোটেই কল্যাণকর হবে না।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে যখন বাজারে ব্যাংকের সংখ্যা কমে যায়, তখন অধিকসংখ্যক আমানত ও মুনাফা স্বল্পসংখ্যক ব্যাংকগুলোয় পুঞ্জীভূত হয়। এজেন্সি তত্ত্বের মতে এই পরিস্থিতিতে স্বল্পসংখ্যক ব্যাংকে পুঞ্জীভূত এই অধিক পরিমাণ আমানত ও মুনাফার অপব্যবহার বেড়ে যেতে পারে, যার ফলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু, বাংলাদেশের আর্থিক বাজারে সুশাসনের অভাব সর্বজনবিদিত। এই প্রেক্ষাপটে আমানত ও মুনাফা স্বল্পসংখ্যক ব্যাংক ও তার মালিকদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া আরও বিপজ্জনক হতে পারে।
বাংলাদেশে ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি এমন একটি সময়ে শুরু করা হয়েছে, যখন বিশ্বব্যাপী সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী। উচ্চ সুদের হার মানুষকে ব্যাংকমুখী করে এবং ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়াতে সহায়তা করে।
এই সময়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ব্যবসা করার সুযোগ না দিয়ে তাদের অধিগ্রহণ কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। উচ্চ সুদের কারণে অধিক আমানতের সরবরাহ যদি স্বল্পসংখ্যক ব্যাংকগুলোয় পুঞ্জীভূত হয়, তাহলে ব্যাংক পরিচালক ও মালিকদের মাধ্যমে ওই আমানতের অনৈতিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশে শেয়ার বাজার অত্যন্ত দুর্বল এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ ও তারল্য জোগানের জন্য ব্যাংকিং খাতের অবদান অনস্বীকার্য। তা ছাড়া ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক পরামর্শ প্রদান করে থাকে।
সুতরাং অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যাংকিং খাতে যদি প্রতিযোগিতা রক্ষা করা না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। এ অবস্থায় ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে স্বল্পসংখ্যক ব্যাংককে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যাংক অধিগ্রহণের কারণে স্বল্পসংখ্যক ব্যাংকের বাজার নিয়ন্ত্রণের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়, তার ফলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক ম্যানেজারদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কনসেনট্রেশন-ফ্রাজিলিটির তত্ত্ব অনুসারে এই আগ্রাসী আচরণের কারণে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণের সুদ বৃদ্ধি করলে ভালো গ্রাহক বা নিম্ন ঝুঁকির গ্রাহকেরা ঋণ নেওয়া থেকে বিরত থাকে এবং অধিক পরিমাণ ঋণ উচ্চ ঝুঁকির গ্রাহকদের কাছে চলে যায়। ফলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকগুলোর ডিফল্ট ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এই অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে যদি আমরা ব্যাংকিং খাতের চলমান সুশাসনের অভাবকে যুক্ত করি, তবে একীভূত–পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং খাতের মন্দ ঋণের পরিস্থিতি আরও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
ব্যাংক একীভূতকরণের যে জোয়ার সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছে, সেই জোয়ারে যেকোনো সময় যে ভাটার টান পড়তে পারে, তা মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন। অধিকাংশ একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ ব্যর্থ হয়ে যায় একীভূতকরণ–পরবর্তী একত্রীকরণ প্রক্রিয়ার জটিলতার জন্য। দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন কাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাদের কাজের দর্শন, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রক্রিয়া বা আর্থিক বিবরণী উপস্থাপনশৈলী ইত্যাদিও ভিন্ন হতে পারে।
এসব ভিন্নতাকে একছন্দে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংক কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা প্রভাবিত হতে পারে। সর্বোপরি একটি বিশাল শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি চাকরি হারানোর বা পদ অবদমনের আশঙ্কার কারণে তাদের স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা বা কর্ম প্রণোদনা হারিয়ে ফেলতে পারে। এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংক একীভূতকরণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে এবং অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
ব্যাংক একীভূতকরণের মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা। অথচ দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বল হওয়ার পেছনে কিন্তু বাজারভিত্তিক কোনো কারণ নেই। শুধু সুশাসনের অভাব আর আইন প্রয়োগের অবহেলাই এর জন্য দায়ী। অধিকাংশ দুর্বল ব্যাংকই শুরুতে সবল ব্যাংক হিসেবেই ব্যবসা করছিল। সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় ঋণ বিতরণের মাধ্যমে এসব ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকে পরিণত করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতি বাজারসৃষ্ট নয়, বরং তা আমাদেরই ভেতর লুকিয়ে থাকা অতিশয় চতুর, লোভী ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট। বছরের পর বছর বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাঁদের আরও শক্তিশালী করেছে এবং নব উদ্যমে গ্রাহকের টাকা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের সাহস জুগিয়েছে। বলা হচ্ছে যে দুর্বল ব্যাংকের মন্দ ঋণগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে, যাতে করে মন্দ ঋণের কোনো প্রভাব অধিগ্রহণকারী সবল ব্যাংকগুলোর ওপর না পড়ে।
যদি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলো মন্দ ঋণ ক্রয়ে আগ্রহী হয়, তবে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেরাই এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একীভূতকরণের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি মহল একীভূতকরণের ধোয়া তুলে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ঋণখেলাপিদের বেলআউট করতে আগ্রহী। এভাবে সাধারণ জনগণের নজর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পরিণাম অর্থনীতির জন্য মোটেই কল্যাণকর হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ