বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে সরকার। ফলে, বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ। দাম বাড়িয়ে যা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে (পিএসএমপি) ২০২৪ সালে বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ১২৯ মেগাওয়াট। অথচ বাস্তবে এ বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতিরিক্ত সক্ষমতা রয়েছে নয় হাজার মেগাওয়াট।
এর বাইরেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (শিল্পে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ) এবং গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এমন নবায়নযোগ্য শক্তি আছে তিন হাজার ২২৩ মেগাওয়াট।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকার কারণে সরকারকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
‘ফলে উচ্চ উৎপাদন খরচ মেটাতে সরকারকে বারবার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে।’ উৎপাদন খরচ বাড়ে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে—যে চার্জ অলস বসে থাকা প্রতি ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া বাবদ দিতে হয়।
বিশ্বের নানা দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ চাহিদার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি রাখাই নিয়ম, যাকে রিজার্ভ মার্জিন বলা হয়—যা মূলত অব্যবহৃতই থাকে।
২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যান বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে যখন সর্বোচ্চ চাহিদা ২১ হাজার ৯০৩ মেগাওয়াট হবে, তখন রিজার্ভ মার্জিন ২০ শতাংশ হিসেবে উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজারের কিছু বেশি হবে।
কিন্তু বিদ্যুতের ওই পরিমাণ চাহিদা না থাকায় বাস্তবে রিজার্ভ মার্জিন ৩৫ শতাংশের বেশি হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
২০১৮ সালে একবার সংশোধন করা মাস্টারপ্ল্যানটি আরও বলছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী করতে নির্দিষ্ট হারে রিজার্ভ মার্জিন থাকা জরুরি। তবে অপরিকল্পিত ও আগ্রাসী সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ মার্জিন বেড়ে গিয়ে দেশের অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে।
মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে কতটা রিজার্ভ মার্জিনের দরকার হবে, তা নির্ধারণে নিবিড় গবেষণার প্রয়োজন।
আগের মাস্টারপ্ল্যানের ফলোআপ হিসেবে ২০২৩ সালে প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০৪০ সালের আগে রিজার্ভ ক্যাপাসিটি ২০ শতাংশের কাছাকাছিও নেমে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ এর দশকে রিজার্ভ সক্ষমতা থাকবে ৩০ শতাংশের আশপাশে। সরবরাহ-চাহিদার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে গত সপ্তাহে এক গবেষণায় সিপিডি বলেছে, বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা না করেই সরকার সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।
এতে উঠে আসে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আনুপাতিক হারে বাড়লেও পরবর্তীতে বিদ্যুতের চাহিদা রেখা ও উৎপাদন সক্ষমতার রেখা বিপরীতমুখী। অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে সরকারকে প্রতিদিন বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। সরকারি কোষাগার থেকে তাদের জন্য গুণতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
গত অর্থবছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। সিপিডির গবেষণা বলছে, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েওে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবিকে লোকসান দিতে হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। অবশ্য সরকার তাদের ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।
সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি আর সরকারের ভর্তুকি বাড়ানোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি খরচ হচ্ছে পিডিবির। পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ক্যাপাসিটি পেমেন্টের জন্যও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে।
‘এই খরচ বৃদ্ধির পেছনে জনগণের কোনো দায় নেই। সেক্ষেত্রে সরকার কেন এই খাতের ভর্তুকি কমানোর নামে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত খরচের বোঝা জনগণের ওপর চাপাবে?’ তিনি প্রশ্ন রাখেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অনেকগুলো কোম্পানি করেছে সরকার, যার কোনোটিই কিন্তু লোকসানে নেই। একমাত্র পিডিবি ছাড়া বাকি সব কোম্পানি লাভ করছে, তাদের থেকে লাভের অংশ নিচ্ছে সরকার, ডিভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নিচ্ছে, করপোরেট ট্যাক্স নিচ্ছে।
অন্যদিকে সরকার যখন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ব্যবসায় নিয়ে আসে, তখন তারা কোনো প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করেনি। ফলে তারা কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে, কেউ জানে না বলে মন্তব্য করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, যখন বিদ্যুতের চাহিদা মাত্র তিন শতাংশ বেড়েছে, তখন সরকার সক্ষমতা বাড়িয়েছে ১২ শতাংশ। ‘এটা অন্যায়, জনগণের সঙ্গে অবিচার’ তিনি বলেন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সরকার সক্ষমতা হিসাব করতে অনেক পরিত্যক্ত বা পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও হিসাবে রাখে।
‘এটা সরকারের সাফল্যকে বৃহত্তর পরিসরে দেখানোর জন্যই করা হয়। কিন্তু আদতে রিজার্ভ ক্যাপাসিটি কমবেশি ২০ শতাংশই, এর বেশি নয়।’
আপনার মতামত জানানঃ