কখনো খুবই আনন্দিত, আবার কখনো খুবই বিষণ্ণ। সহজ ভাষায় বলতে, দীর্ঘসময় ধরে একজন ব্যক্তির মুডের, আবেগের বা মানসিক অবস্থার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে বর্ণনা করে থাকেন চিকিৎসকরা।
অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো কখনো দীর্ঘসময় ধরে বিষণ্ণতা বা মন খারাপের মধ্যে থাকেন। কখনো কখনো সেটা কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে। আবার একই ব্যক্তি একসময় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ করতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি অতিরিক্ত হাসিখুশি বা উচ্ছ্বাস প্রবণ হয়ে ওঠেন।
ডায়াবেটিসের মতো বাইপোলার ডিসঅর্ডার একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। ওষুধ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় না।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কী?
বাইপোলার মানে হচ্ছে দুই মেরু। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মানসিকতার এক প্রান্তে থাকে উৎফুল্লতা, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রবণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ম্যানিয়া এপিসোড। রোগী অতিরিক্ত উৎফুল্ল থাকেন, কথা বেশি বলেন, অনেক সময় জিনিসপত্র বিলিয়ে দেন।
আরেকপ্রান্তে থাকে বিষণ্ণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ডিপ্রেশন এপিসোড। এই সময় তার কিছুই ভালো লাগে না, হতাশায় ভোগেন, দুঃখ বোধ প্রবল থাকে। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
এই দুইয়ের মাঝামাঝি সময়ে রোগী ভালো থাকেন। সেই সময় অন্য সব মানুষের মতোই স্বাভাবিক আচরণ করেন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মেখলা সরকার বলছেন, একেকটি এপিসোড (ম্যানিয়া অথবা ডিপ্রেশন) কখনো কখনো কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরেও চলতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কেন হয়?
বাইপোলার ডিসঅর্ডার ঠিক কোন কারণে হয়, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এর পেছনে কয়েকটি উপাদান কাজ করে থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে অন্তত একজন জীবনের কোন একটি পর্যায়ে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগে থাকেন।
অধ্যাপক ডা: মেখলা সরকার বলছেন, অনেক সময় জেনেটিক্যালি বা বংশগত কারণে বাইপোলার রোগটি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে চলে আসে।
বিশেষত মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, ডোপামিন, নরঅ্যাড্রেনালিন ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, স্বায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক রোগের ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি কারণে বাইপোলার হতে পারে।
সাধারণত তরুণ বয়সে এই রোগের প্রকাশ দেখা যায়। নারী ও পুরুষ-উভয়েরই এই রোগটি হতে পারে। একজন থেকে আরেকজনের সাথে লক্ষণের পার্থক্য থাকতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি হাজারে চারজন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গবেষণায় অংশ নেয়া প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে চারজন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারে ভুগছেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী একজন তরুণী বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই বাইপোলার রোগে ভুগতে শুরু করেছিলেন।সেই সময় তিনি দিনের পর দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘরের বাইরে বের হতেন না। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন- কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। ঠিকমতো খাবার খেতেও ইচ্ছা করতো না।
আবার কিছুদিন পরেই সেই একই মানুষ একেবারে উল্টো আচরণ করতে শুরু করতেন। তখন বাসায় পার্টি করা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া শুরু হয়। ইচ্ছামতো দরকারি-অদরকারি জিনিসপত্র কিনতে শুরু করেন। রাতে ঘুমাতেন না, টাকা পয়সার খরচে কোন হিসাব থাকতো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তরুণী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”পরিবারের সদস্যরা প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি কোন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছি কিনা। সেটা হয়নি বোঝার পর তারা আমাকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। তখন চিকিৎসক জানালেন, আমি বাইপোলারে আক্রান্ত।”
সেই সময় থেকেই তিনি নিয়মিত ওষুধ এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করার পর এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন এই তরুণী।
”এখনো মাঝে মাঝে মুড চেঞ্জ হয়, আমি টের পাই। মন খারাপ হয়, বা অযথা কেনাকাটা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তারপরও এমন সব আচরণ করে ফেলি, যা হয়তো করতে চাই, পরে অনুশোচনা হয়,” তিনি বলছিলেন।
আচরণ পরিবর্তনের কারণে কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনেক সময় তার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও তিনি জানান।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কী চিকিৎসা রয়েছে?
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মেখলা সরকার বলছেন, এখন বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা শহরেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কারও মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ দেখা গেলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
”আমরা বলি না, এটা একেবারে নিরাময় সম্ভব। তবে ডায়াবেটিস রোগের মতো নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব,” বলছেন অধ্যাপক সরকার।
এরপর চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ এবং পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে থাকলে এই রোগটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে তিনি বলছেন।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, কারও মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা যেকোন মানসিক রোগ দেখা গেলে অবশ্যই স্বজনদের উচিত তার সঙ্গে সতর্ক আচরণ করা। বিশেষ করে তার সঙ্গে সরাসরি কোন তর্ক না করা, জোরাজুরি করা উচিত নয়।
আপনার মতামত জানানঃ