জ্বালানি উপকরণ, রোজার পণ্য ও বকেয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে নতুন করে বিদেশ থেকে চড়া সুদে ৩১০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে। পুরোটাই স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ঋণ গ্রহণের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ঋণদায় পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভে আরও চাপ বাড়বে। এদিকে রোজার পণ্য ও জ্বালানি তেল আমদানি জরুরি হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ খাতে চড়া শোধে ঋণ নিয়ে আমদানির পাশাপাশি আগের দায় শোধ করা হবে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেব্রুয়ারিতেই ছয় মাস মেয়াদি ট্রেড ক্রেডিটের আওতায় রোজার পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে রোজাসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি করতে পারবে।
ইতোমধ্যে ভারত, সৌদি আরব ও অন্য কয়েকটি দেশের বেশকিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০ ডলারের ট্রেড ক্রেডিট রোজার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য আরও আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বর্তমানে বেশির ভাগ ঋণই নেওয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তঃব্যাংক ঋণের সুদহার সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেটের (সোফর) ভিত্তিতে। মার্কিন ডলারের ছয় মাস মেয়াদি বন্ডের সুদের হার এখন ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এর সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ যোগ করে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ফলে সুদের হার দাঁড়াচ্ছে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতে কিছু ঋণ নেওয়া হচ্ছে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটে (লাইবর)। এ বাজার ছয় মাস মেয়াদি ডলার বন্ডের সুদের হার ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
ফলে এর সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করলে সুদের হার দাঁড়াচ্ছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যে ব্যাংক ঋণের মধ্যস্বত্বকারী হিসাবে কাজ করছে তারা কমিশন বাবদ দিচ্ছে আরও ১ শতাংশ। ফলে ঋণের সুদহার ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ পড়ছে। এর আগে ট্রেড ক্রেডিটের এসব ঋণ পাওয়া যেত ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদে।
জ্বালানি তেল আমদানি ও জ্বালানি খাতের আগের দেনা পরিশোধ করতে সরকার সৌদি আরবের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে ছয় মাস মেয়াদি। এগুলোর সুদও একই হারে পড়বে। সৌদি আরবের বিভিন্ন তেল কোম্পানির খাঁচ থেকে এসব ট্রেড ক্রেডিট নেওয়া হবে।
আপাতত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে বাকিতে জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে সরকার এসব ঋণ পরিশোধ করবে। এ বিষয়ে সৌদি আরবের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ঋণ দিয়ে আগের দেনা সমন্বয় করা হচ্ছে।
এদিকে জ্বালানি উপকরণ আমদানিতে সরকার ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ৬ মাস মেয়াদে নেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ডলার। এ খাতে মোট ২১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করা হবে। এর মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাকি ৫০ কোটি ডলার আইটিএফসি থেকে জোগান দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, আসন্ন গরমের মৌসুমে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তহবিলে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করা হবে। জ্বালানির উপকরণ আমদানির বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় অনেক বিদেশি কোম্পানি এখন দেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ করতে চাচ্ছে না।
এ কারণে স্পট থেকে নগদ আকারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে এ খাতের আমদানির বকেয়া অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতে ২১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আইডিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ৬০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছ। এর বিপরীতে মার্কিন মুদ্রা বাজারের সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করে সুদ দিতে হবে। বর্তমানে সোফর রেট ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করলে সুদহার দাঁড়াচ্ছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ঋণের মেয়াদ হবে ছয় মাস। তবে এর মেয়াদ আরও বাড়ানো যাবে।
তহবিলের বাকি ১৬০ কোটি ডলার জোগান দেওয়া হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। তবে রিজার্ভ থেকে ওই অর্থ একসঙ্গে দেওয়া হবে না। পর্যায়ক্রমে জোগান দেওয়া হবে। আইটিএফসি রিজার্ভ থেকে ওই অর্থ আলাদা করতে বলেছে। এর সঙ্গে তাদের ঋণের ৫০ কোটি ডলার যোগ হবে। সোফরের সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করে এর সুদহার নির্ধারিত হবে। ফলে সুদহার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এদিকে রিজার্ভ থেকে ওই অর্থ আলাদা করলে আইএমএফ-এর মান অনুযায়ী ১৬০ কোটি ডলার রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। এতে নিট রিজার্ভ কমে যাবে।
আন্তর্জাতিক ঋণ নেওয়ার সুদের হারের প্রধান দুটি উপকরণ সোফর ও লাইবর দুটির সুদহারই এখন বেড়ে গেছে। ফলে চুক্তি অনুযায়ী অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে।
স্বল্পমেয়াদি ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশেরই সুদহার নির্ধারিত হয় বাজার দরের ভিত্তিতে। ফলে বর্তমানে স্বল্পমেয়দি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এর প্রায় সব ঋণেরই সুদহার বাড়বে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৯ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। এসব ঋণের ৭৫ শতাংশ সুদহার বাজারভিত্তিক। ফলে এসব ঋণের সুদের হার বাড়বে।
এসব ঋণ পরিশোধের সময় দুভাবে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সুদের হার বাড়ায় বাড়তি সুদ দিতে হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় স্থানীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি দামে ডলার কিনে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতেও টাকার অঙ্কে বেশি ঋণ পরিশোধ হচ্ছে।
গত পৌনে ২ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকার। এদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে যে ঋণ দিচ্ছে তার সুদের হারও বাড়িয়েছে। তারা আগে দশমিক ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিত। এখন তা বেড়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে। তবে আগের নেওয়া ঋণের সুদহার তারা দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে দশমিক ৭৫ শতাংশই অব্যাহত রেখেছে।
আপনার মতামত জানানঃ