বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠানটিকে ছয়টি অর্থ বছরের জন্য ১১৯ কোটি টাকারও বেশি আয়কর পরিশোধ করতে হবে। হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকার ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেন।
মামলার নথি অনুযায়ী, গ্রামীণ কল্যাণের কাছে আয়কর কর্তৃপক্ষের পাওনা দাবি ছিলো প্রায় ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থ বছর থেকে ২০১৬- ২০১৭ অর্থ বছর পর্যন্ত আয়কর বাবদ এই পাওনা দাবি করা হয়েছিল।
বিভিন্ন সময়ে ছয়টি অর্থ বছরের জন্য গ্রামীণ কল্যাণের পক্ষ থেকে মোট সাতটি আয়কর রেফারেন্সের এসব মামলা করা হয়। গ্রামীণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, “ড. ইউনূসের করা এসব আয়কর রেফারেন্স মামলা খারিজ করে এ রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।”
তিনি আরও বলেন, “সে সময় এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু রিটার্নে যে খরচ দেখানো হয় তার স্বপক্ষে দলিল দেখাতে না পারায় তখন তা বাতিল করে দেওয়া হয়।”
“কিছু খরচের স্বপক্ষে দালিলিক প্রমাণ দেখালেও তা যথাযথ নয় বলে গ্রহণ করেনি আয়কর কর্তৃপক্ষ।”
“পরে ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেসের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনার অব আপিলের কাছে আপিল করে অধ্যাপক ইউনূসের এই প্রতিষ্ঠান। এই আপিলে হারার পর ট্যাক্সেস আপিলেট ট্রাইব্যুনালে যায় তারা। সেখানেও হেরে যায় প্রতিষ্ঠানটি”, জানান মি. উদ্দিন।
আইনানুযায়ী, প্রত্যেক আপিল করার সময় টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। “সবগুলো জায়গায় হেরে যাওয়ার পর হাইকোর্টে এসে আয়কর রেফারেন্স মামলা করেন ড. ইউনূস”, বলেন মি.উদ্দিন।
“আইনানুযায়ী প্রতিটা আপিলের সময় টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে আপিল করার সময় টাকা জমা দেওয়ার ফলে আয়কর কর্তৃপক্ষের যে ৫৫৫ কোটি টাকার বেশি দাবি ছিলো তার থেকে এখন ১১৯ কোটি টাকা দিতে হবে অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ কল্যাণকে”, জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
এ রায়ের কথা উল্লেখ করে এখন আয়কর কর্তৃপক্ষ তাদের নোটিশ দেবে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, আয়কর কর্তৃপক্ষকে গ্রামীণ কল্যাণ এখন এ অর্থ পরিশোধ করবে।
ট্যাক্সেস আপিলেট ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর আয়কর কর্তৃপক্ষের মোট দাবি ছিলো ৫৫৫ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি।
বিভিন্ন পর্যায়ে আপিল আবেদন করার সময় পরিশোধ করে এখন কর্তৃপক্ষ পাবে ১১৯ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, “ড. ইউনূসের আইনজীবীর মূল যুক্তি ছিল অডিট ফার্মের রিপোর্ট থাকলে আর ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করতে পারে না।”
“কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আরো ২০ বছর আগের রায়ে বলা হয়েছে, অডিট ফার্মের রিপোর্টই মূল ভিত্তি নয়। বরং রিপোর্ট কীসের ভিত্তিতে করা হয়েছে তা প্রমাণ করতে না পারলে অডিট রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করা যাবে।”
দীর্ঘদিনের আইনি প্রক্রিয়া শেষে এই রায় এলো বলে জানান মি.উদ্দিন। গ্রামীণ কল্যাণের আইনজীবী সরদার জিন্নাত আলী জানান, “গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
এর আগে গত বছরের ৩১শে মে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত তিনটি ট্রাস্টে দান করা অর্থের বিপরীতে তিন করবর্ষে আয়কর কর্তৃপক্ষের ‘দানকর’ আরোপ বৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।
এর বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করলেও তা খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। ওই আদেশের ফলে তাকে দানকর হিসেবে সাড়ে ১২ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। যে তিনটি ট্রাস্টে দানকর দিতে হয় সেগুলো হলো প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট ও ইউনূস সেন্টার ট্রাস্ট। এই তিনটি ট্রাস্টে অধ্যাপক ইউনূস দান করেন।
তিন ট্রাস্টে দান করা অর্থের বিপরীতে আয়কর কর্তৃপক্ষ ‘দানকর’ আরোপ করে। যা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। গত ১লা জানুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করে ঢাকার একটি শ্রম আদালত।
এ রায়ের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ-পাচার ও আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে।
সম্প্রতি এ মামলায় জামিন পেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস-সহ সাতজন। বাকিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। আগামী ২রা এপ্রিল এ মামলায় অভিযোগপত্র গ্রহণের বিষয়ে শুনানি রয়েছে। এটিই অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের একমাত্র মামলা। বাংলাদেশে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মোট ১৮টি মামলা চলছে।
এসব মামলা স্থগিত ও বিচারিক হয়রানি বন্ধ চেয়ে আন্তর্জাতিক মহল আহ্বান জানিয়ে আসছিল। অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে কি না, তা দেখতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে আসার আহ্বানও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বাংলাদেশে আসতে নোবেল বিজেতারা-সহ মোট ২৪২ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব খোলা চিঠিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পরে ড. ইউনূসের আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাদের আসার ব্যাপারটা সরকারের অনুমতির উপর নির্ভর করে।
আপনার মতামত জানানঃ