ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যস্ত সফরসূচির মধ্যে আগস্ট ২০১৫ সালে আবুধাবির শেখ জায়েদ মসজিদ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। ঠিক একদিন পরে প্রতিবেশী দুবাইতে একটি জনসভায় ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল তার।
ততদিনে ২০০৭ সালে নির্মিত এই বিশাল মসজিদটি একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে আবুধাবিতে আগত বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং পর্যটকদের কাছে।
মসজিদ চত্বরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মোদী সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুই প্রবীণ কর্মকর্তার সঙ্গে সেলফি তোলেন। সেখানে উপস্থিত উৎসাহী জনতা যারা ‘মোদী মোদী’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন প্রধানমন্ত্রী। তাদের অভিনন্দন জানান।
সে দৃশ্য ছিল উৎসবের মতো। এর কিছুক্ষণ পর একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের একজন উপস্থাপকের টেলিফোন পেলাম।
তিনি আমাকে সরাসরি একটি প্রশ্ন করলেন, “বোরকা পরা নারীরা মসজিদের ভিতরে মোদীর স্লোগান দিচ্ছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?”
আসলে, মসজিদে জড়ো হওয়া একদল ভারতীয় ওই স্লোগান দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন বোরকা পরে ছিলেন। এর কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিও টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়। যদিও এই ‘উৎসাহী’ রিপোর্টিংয়ের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়ে গিয়েছিল।
মসজিদে প্রবেশের নিয়ম অনুযায়ী, সেখানে প্রবেশকারী নারীরা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাদের হিজাব পরতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে একটি মুসলিম দেশে মসজিদে মুসলিম নারীরা প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ঘিরে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন-তা কিন্তু সঠিক ব্যাখ্যা নয়।
ধারণা এবং সত্যতা
গত ১০ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রায় সবক’টি সফরই বড় ঘটনা। দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জনসভা, ২০১৮ সালে ‘ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট’-এ মূল বক্তা হিসাবে তার ভাষণ, এবং গত বছর অনুষ্ঠিত ‘সিওপি-২৮’ জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মোদীর বক্তৃতা সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
যদিও নরেদ্র মোদীর সফরকে ঘিরে প্রচার প্রায়শই ধারণা এবং বাস্তবের রেখাকে ঝাপসা করে দেয়। এই কোলাহলের মাঝে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা প্রায়শই উপলব্ধি এবং সত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আরও একবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে রয়েছেন (১৩-১৪ই ফেব্রুয়ারি)। ২০১৫ সাল থেকে এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে তার সপ্তম এবং গত আট মাসে তৃতীয় সফর। এই সফর চলাকালীন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে ‘অহলান মোদী’ নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভারতীয় সম্প্রদায়ের বৃহত্তম শীর্ষ সম্মেলন হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে এই অনুষ্ঠানটিকে।
আয়োজকরা জানিয়েছেন ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য নাম নথিভুক্ত করেছেন। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, দুবাইয়ে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট’২০২৪-এর প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
প্রসঙ্গত, এই সফরের সময়েই ১৪ই ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে স্বামীনারায়ণ মন্দিরের উদ্বোধন হতে চলেছে। এই বিশাল মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিএপিএস স্বামীনারায়ণ সংস্থার তৈরি এই মন্দিরে সাতটি চূড়া এবং পাঁচটি অলঙ্কৃত গম্বুজ রয়েছে।
জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনের আগে এই উপলক্ষে এক মাসব্যাপী ‘সম্প্রীতির উদযাপন’-এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিএপিএস স্বামীনারায়ণ সংস্থার প্রধান মহন্ত স্বামী মহারাজ আবুধাবিতে রয়েছেন। তারই নেতৃত্বে মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হতে চলেছে।
আরব দেশে ক’টি হিন্দু মন্দির রয়েছে?
কয়েক বছর ধরে তৈরি এবং ছড়িয়ে দেওয়া ভুল ধারণা, অতিকথা শুধুমাত্র ভ্রান্তধারণাই সৃষ্টি করেনি, জন্ম দিয়েছে মিথ্যেরও। এসবের সূত্রপাত এই বক্তব্যের হাত ধরে যে আবুধাবিতে নির্মিৎ স্বামী নারায়ণ মন্দির আরব বিশ্বের প্রথম হিন্দু মন্দির। যা সঠিক তথ্য নয়।
বিশ্বের এই প্রান্তে কিন্তু কয়েক দশক ধরে মন্দির রয়েছে। শুধুমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতেই (ইউএই) নয়, ওমান এবং বাহরাইনেও আছে। বাহরাইনের রাজধানী মানামায় নির্মিত শ্রীনাথজির মন্দির এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। সিন্ধি হিন্দু সম্প্রদায় দ্বারা এই মন্দির নির্মিত যারা ভারতের বিভাজনের আগেই থাট্টা (পাকিস্তান) থেকে চলে এসেছিলেন।
প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবে বসবাসকারী ও কর্মরত হিন্দুরাও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় এই মন্দিরগুলিতে পূজা দিতে আসেন। ওমানের রাজধানী মাস্কাটে দুটি হিন্দু মন্দির রয়েছে। মতিশ্বর মন্দির ভগবান শঙ্করের। এটি ওল্ড মাসকাটের মুত্রাহ এলাকায় অবস্থিত।
মতিশ্বর মন্দিরটি শঙ্করের যা ওল্ড মাসকাটের মুত্তরা এলাকায় অবস্থিত। মতিশ্বর মন্দির মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এই মন্দির দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বলে মনে করা হয়। ওমানের সুলতান এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন সেখানে বসবাসকারী গুজরাটি সম্প্রদায়ের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে।
বহু দশক আগে থেকে দুবাইয়ে দক্ষিণ ভারতীয় ছাড়াও, সিন্ধি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি-সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য উপাসনা স্থল রয়েছে।
আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান, উত্সব এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র মন্দিরে হয়। দুবাই ও তার আশপাশের কিছু শহর এবং উপসাগরের অন্যান্য অংশে, দীপাবলির রাত ঠিক ভারতের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ধর্ম ও রাজনীতি
কোনও সম্প্রদায় কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ়তার সঙ্গে যখন এগিয়ে যায় তখন তারা সেটাই অর্জন করেন যেটার দাবিদার তারা। সমগ্র উপসাগরীয় দেশে, বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভারতীয়দের সাফল্য এরই প্রতিফলন।
এক প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কথায়, ভারতীয়রা তাদের কঠোর পরিশ্রমের কারণে বিশ্বের এই অংশে পছন্দের তালিকায় রয়েছেন। সেই ভাবনাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে বিকৃত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সাথে পরিবেশন করলে তা অবশ্যই প্রভাব ফেলবে সুনামের উপর।
নূপুর শর্মার ঘটনাটি এর বড় উদাহরণ। সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়কে হিন্দি (ভারতের জন্য আরবি) বলা হয়, হিন্দু নয়।
একথা ঠিক যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই মন্দির নির্মাণে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে একে তার রাজনৈতিক বিজয় বা একটি ধর্মের কূটনৈতিক বিজয় হিসাবে দেখানোটা অদূরদর্শীতার প্রমাণ।
এখানে যে একটা দ্বন্দ্ব আছে, তা স্পষ্ট। কারণ ভারতে আজকাল ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোন কিছুই রাজনীতি হয়ে যায়। এবং ঠিক উল্টোদিকে, আরব বিশ্বে এর কোনো স্থান নেই।
বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কোনও কিছুকে যতই রাজনীতির রঙে রাঙানো হোক না কেন, আরব বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে তা শুধুমাত্র রাজনীতি হিসাবেই থাকবে। বিশ্বের এই প্রান্তে ধর্ম জনজীবনের অংশ হয়ে উঠলেও রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের অংশীদার কখনওই হবে না।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে ভারতীয়দের প্রভাব
আরব বিশ্ব, বিশেষত উপসাগরীয় সহযোগী পরিষদের (জিসিসি) দেশগুলো কিন্তু বদলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ভারতীয় সম্প্রদায়েরও পরিবর্তন হচ্ছে। ভারত এবং অন্যান্য দেশের লোকেরা এখানে কাজ করে ভাল অর্থ উপার্জন করেছে।
তারা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে পশ্চিমের কোনও আরও সমৃদ্ধ দেশেও চলে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পশ্চিমা নাগরিকত্ব পাওয়ার পরে, আরও অর্থ উপার্জনের জন্য আবার আরব বিশ্বে ফিরে এসেছেন।
লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে গিয়েছে আরব বিশ্বে কর্মরত ভারতীয়দের পাঠানো অর্থে। এই অর্থের সাহায্যে কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ইউপি এবং বিহারের গ্রামীণ এলাকায় খড়ের ছাউনি পাকা বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই অর্থের উপর ভিত্তি করে অনেক ছোট-বড় ব্যবসা শুরু হয়েছে , পরবর্তীকালে এদের অনেকেরই বিকাশও ঘটেছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলে উপার্জন করা টাকায় গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মজীবনও।
সাম্প্রতিককালে, শুধুমাত্র বড়-সড় নির্মাণক্ষেত্রের শ্রমিক হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, কর্পোরেট সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসাবে তারা খ্যাতি অর্জন করেছেন।
উপসাগরীয় অঞ্চলগুলি ক্রমাগত মেট্রোপলিটন হয়ে উঠছে। তেলের উপর নির্ভরতার পরিবর্তে উচ্চ প্রযুক্তি-নির্ভর অর্থনীতি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি ভারতে শক্তির চাহিদা, সে দেশের প্রতিভা, বিশেষত ভারতীয় আইটি কর্মশক্তির নিরিখে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। এই সম্পর্ক ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও মজবুত হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) কিন্তু সৌদি আরবের অংশ নয়, যেখানে ইসলামের দুটি পবিত্রতম মসজিদ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে আধুনিকীকরণের চেষ্টা সত্ত্বেও, সৌদি আরবের এখনও নিজস্ব রীতিনীতি রয়েছে যা ওই দেশ অনুসরণ করে।
তুলনামূলক ভাবে, সংযুক্ত আরব আমিরাত অনেক ছোট। কিন্তু এভিয়েশন হাব হয়ে ওঠা, পুনঃরপ্তানি ব্যবসার মডেল তৈরি এবং সারা বিশ্ব থেকে প্রতিভা আকৃষ্ট করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে ওই দেশ।
এরই হাত ধরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ে, একে অপরের উপর নির্ভরতা, অন্যদের গ্রহণ করার ক্ষমতা, বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। এর একটি উদাহরণ আবুধাবির আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউস। এখানে মসজিদ, একটি গির্জা এবং সিনেগগ রয়েছে। পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য বিশেষ মঞ্চও রয়েছে।
যেদিন মন্দির প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, সেদিন এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। দুবাইয়ের একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব এক্স-হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইট) লেখেন, ‘একটি মন্দির কীভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভারতীয়দের সমস্যার সমাধান করতে পারে?’
সেই পোস্ট ডিলিট না করা পর্যন্ত তাকে ট্রোল করা হয়। এই ঘটনাকে ঘিরে উচ্ছ্বাস সে দেশে ভারতীয়দের অর্জন করা অগ্রগতিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আশা করা যায়, এই ঘটনাটি একটি ব্যতিক্রম মাত্র।
শেখ জায়েদ মসজিদের কাছাকাছি একটি বিশাল মন্দির সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্প্রীতির ভাবনাকে আরও মজবুত করবে যদি না এর সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং আকাঙ্ক্ষা যুক্ত থাকে।
আপনার মতামত জানানঃ