ই-কমার্সের নামে দেশের লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সে টাকার ঠিকঠাক হিসাব দিচ্ছে না অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চেয়ে কিছু হিসাব নিতে সমর্থ হয়েছে, তবে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়ে গেছে হিসাবের বাইরে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ইভ্যালির গ্রাহকরা ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন, যার ঠিকঠাক তথ্য মেলেনি। আরেক ই-কমার্স আলেশা মার্টের গ্রাহকদের ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেও টাকার হদিস মেলেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অর্থ পেমেন্ট গেটওয়ে (এসক্রো সার্ভিস)-তে আটকে ছিল, তারা শুধু সেই টাকার কিছু তথ্য দিয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কিছু অর্থের সন্ধান মিলেছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে, যেগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল সার্ভার চালু করা ছাড়া বের করা সম্ভব নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে ছিল- সেগুলোর বেশির ভাগই ফেরত দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কিছু টাকা আছে, যেগুলো ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; মামলার কারণে হিসাবগুলো জব্দ থাকায় ওই টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পেমেন্ট গেটওয়ের বাইরে লেনদেনের কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই।
কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেলের তথ্যানুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৭২৬ জন গ্রাহক ৩৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন। ১৫টি প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের এ টাকা ফেরত দিয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়েছে কিউকম। প্রতিষ্ঠানটি ৪৪ হাজার ৩৯ জন গ্রাহককে ৩১১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দালাল প্লাস, বুমবুম, আনন্দবাজার, থলেডটকম, ধামাকা, আলিফওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশডিল, সফেটিক, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপের ফেরত দেওয়া অর্থের পরিমাণ কোটি টাকার নিচে।
এর বাইরে দালাল প্লাস ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং শ্রেষ্ঠডটকম দেড় কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। তবে ই-কমার্স কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বৃহৎ দুটি প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ও আলেশা মার্টের টাকা ফেরত দেওয়ার পরিমাণ প্রকৃত লেনদেনের তুলনায় একেবারেই কম।
সূত্র জানায়, আদালত কর্তৃক নিযুক্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে ৪ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমার বিষয়ে তথ্য দিয়েছিল।
এ অর্থ শুধু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই লেনদেন সম্পর্কে ঠিকঠাক তথ্য দিতে পারেননি ইভ্যালির কর্মকর্তারা। এর বাইরে পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মাত্র ১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে ইভ্যালি। এর বাইরেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ লেনদেন। সার্ভার চালু না হওয়ায় যার হিসাব পাচ্ছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
একই অবস্থা আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন ব্যাংকে আলেশা মার্টের ৫৬টি হিসাবের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেসব হিসাবে গ্রাহকদের ২ হাজার কোটির বেশি অর্থ জমার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। হিসাবগুলোতে ছিল মাত্র ২ কোটি ৭ লাখ টাকা।
এর বাইরে পেমেন্ট গেটওয়েতে যে টাকা আটকে ছিল তার মধ্যে ৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এসক্রো সার্ভিসে লেনদেনকৃত অর্থের মধ্যে বর্তমানে আলেশা মার্টের কাছে ৮ হাজার ২৮৮ গ্রাহকের ১১৬ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তবে এর বাইরে বিপুল পরিমাণ লেনদেনের হিসাব মেলেনি।
বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল থেকে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ ফেরত প্রক্রিয়া সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। মন্ত্রীর দফতরে পাঠানো প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থের মধ্যে কিউকমের গ্রাহকদের ৭২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আটকা রয়েছে; ধামাকা শপিংয়ের গ্রাহক ও মার্চেন্টের আটকা রয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা, সিরাজগঞ্জ শপের ২ হাজার ৭০০ গ্রাহকের ১৪ কোটি টাকা এবং আলাদিনের প্রদীপের গ্রাহক ও মার্চেন্টের ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আটকে আছে।
এ ছাড়া সূর্যপে লিমিটেডের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৩৮০ জন গ্রাহকের অর্থ ফেরতের তালিকা দালাল প্লাসকে দেওয়া হলেও তারা মাত্র ২ হাজার ৪২০ জন গ্রাহককে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। অবশিষ্ট টাকা দালাল প্লাসের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্ত্রীকে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর যে টাকা এসক্রো সার্ভিসে আটকে ছিল, তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে শুধু সেগুলোই ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়ে গেছে, যার কোনো হিসাবই মিলছে না। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভার চালু করা গেলে খোয়া যাওয়া অর্থ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা সহায়তা করছেন না। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ই-কমার্স কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক যে টাকা ফেরত পেয়েছেন তা খোয়া যাওয়া অর্থের ৫ শতাংশের মতো। বাকি ৯৫ শতাংশ অর্থ হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল সার্ভার পুনরুদ্ধার করে বের করা সম্ভব। কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভার চালু করতে না পারলে ই-কমার্স কেলেঙ্কারির এই হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধারার অর্থনীতিতে কখনো ফেরত আসবে না। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরাও ফেরত পাবেন না তাদের লেনদেনের অর্থ।
আপনার মতামত জানানঃ