দেশে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) ঘাটতি ছিল ৬৬৫ কোটি ডলারের বেশি। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে তা ৮২২ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ ঘাটতি হিসাবের সময় ভুলভাবে উপস্থাপিত, একপাক্ষিক বা বাদ পড়া লেনদেনের (নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস বা এনইও) তথ্য সমন্বয় করতে হয়েছে ৩২২ কোটি ডলারের (ঋণাত্মক), যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বিওপি ঘাটতির ৩৯ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও (জুলাই-আগস্ট) বিওপি ঘাটতির প্রায় ৪৭ শতাংশই ছিল এররস অ্যান্ড ওমিশনসজনিত।
গত অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি দাঁড়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চে। এ ঘাটতির বড় অংশজুড়ে রয়েছে এররস অ্যান্ড ওমিশনস। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের ভাষ্যমতে, বৈদেশিক লেনদেনের আন্তঃ ও বহিঃপ্রবাহের হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত ব্যালান্সের যে পার্থক্য পাওয়া যায়, সেটিকেই নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দীর্ঘ সময় এনইও ঋণাত্মক অংকে থাকলে এটিকে চিহ্নিত করা হয় সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পুঁজি বের হয়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কমিটি অন ব্যালান্স অব পেমেন্ট স্ট্যাটিস্টিক্সের ৩২তম বৈঠকে উপস্থাপিত নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, এনইও ঋণাত্মক পর্যায়ে নেমে আসার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে সম্পদ বের হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনসের অংকটি দীর্ঘদিন ধরেই ঋণাত্মক পর্যায়ে অবস্থান করছে। মোট বিওপিতে এর অংশটিও অনেক বড়। সে হিসেবে বলা চলে দেশে বিওপি ঘাটতির বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে ভুল বা বাদ পড়া লেনদেনের অংক, যার বড় একটি অংশের কোনো হদিস কারো কাছে নেই। ভুল বা বাদ পড়ে যাওয়ার এ পরিসংখ্যানকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। একই কথা উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণেও।
সংস্থাটির চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনের অক্টোবর সংস্করণের ভাষ্যমতে, এনইও পরিসংখ্যানে মিসইনভয়েসিংসহ (বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি-রফতানির প্রকৃত তথ্য আড়াল) অবৈধ নানা পন্থায় পুঁজি পাচারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বলে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আবার বিনিময় হারে ওঠানামার কারণে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্য অর্থ প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করার বিষয়টিও এক্ষেত্রে আংশিক ভূমিকা রাখতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উৎসের ভিন্নতার কারণে সব দেশেই বিওপি হিসাব করতে গিয়ে কিছু মাত্রায় নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ হার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। আবার তা দীর্ঘমেয়াদে ঋণাত্মক পর্যায়ে অবস্থানের বিষয়টিও যথেষ্ট উদ্বেগের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে বিওপি ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণাত্মক ৩৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা প্রায় ৫৫ শতাংশ ছিল এররস অ্যান্ড ওমিশনস। এরপর গত অর্থবছরে ৮২২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিওপি ঘাটতির মধ্যে ভুল বা বাদ পড়া লেনদেনের অংশ দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ দশমিক ২ শতাংশে, যার পরিমাণ ঋণাত্মক ৩২২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিওপির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। এর মধ্যে এররস অ্যান্ড ওমিশনস আছে ঋণাত্মক ৭৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বা ৪৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এররস অ্যান্ড ওমিশনস সবসময় ঋণাত্মক থাকার অর্থ হলো তা দৈবাৎ বা এলোমেলো কিছু নয়। এটি ঋণাত্মক হওয়ার মানে হলো অর্থের বহিঃপ্রবাহ ও আন্তঃপ্রবাহের যে ব্যবধান, রিজার্ভ থেকে ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও বেশি। আর এ ব্যয়ের অংকটা যেহেতু হিসাবে পাওয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি, তার মানে তা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এ থেকে অর্থ পাচারের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায়ও এররস অ্যান্ড ওমিশনস মাইনাসে থাকাকে অবৈধ পুঁজি পাচারের একটি সূচক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে একমুখী বা ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ হলো এখানে এমন কিছু একটা ঘটছে যা জানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এ ভুল শুধুই ভুল না।’
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের বড় একটি মাধ্যম হলো মিসইনভয়েসিং বা বৈদেশিক বাণিজ্যে ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং। বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশীদার দেশগুলোর তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি তথ্যের গরমিল দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এমনকি দেশের সংশ্লিষ্ট এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার তথ্যেও বেশ অমিল পাওয়া যায়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, রফতানি বাবদ প্রাপ্ত অর্থের সবটা দেশে আসছে না। বৈদেশিক বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পুঁজি চলে যাওয়ার কথাও আমরা শুনছি। একই সঙ্গে হুন্ডিও এখানে বড় একটি ভূমিকা রাখছে। হুন্ডির ব্যবসাটাও রমরমা থাকবে যদি অর্থ পাচারের চিত্রটা আরো বাড়তে থাকে। এত শ্রমিক দেশের বাইরে যাওয়ার পরও বৈধ পথে রেমিট্যান্স না আসার বড় একটি কারণ হলো হুন্ডি।
আমি মনে করি বিওপি পরিসংখ্যানে ভুল বা বাদ পড়া লেনদেনের তথ্যকে শুধু পরিসংখ্যানগত পার্থক্য বা ভুল হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এখানে অর্থ পাচার গভীরভাবে সম্পর্কিত। বিশ্বব্যাংকও একই কথাই বলছে। সামগ্রিকভাবে এটি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটবে না। আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টের চাপ প্রশমনেরও কোনো সুযোগ থাকছে না।’
তবে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এররস অ্যান্ড ওমিশনসের নির্ধারিত সংজ্ঞা রয়েছে। দেশের ইতিহাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাব এখন প্রথমবারের মতো ঋণাত্মক পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ যে পরিমাণে এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টটা ঋণাত্মকে নেমেছে। আমরা মনে করি ব্যালান্স অব পেমেন্টের যে সর্বশেষ পরিস্থিতি, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টই এর মূল কারণ।’
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে (২০১৪ সালের হিসাব বাদ দিয়ে) বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৮২৭ কোটি ডলার। তবে বর্তমানে এ অংক এরই মধ্যে বার্ষিক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে বলে সন্দেহ অনেক বিশেষজ্ঞের।
বিওপিতে ভুল বা বাদ পড়ার তথ্যটিকে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের তথ্যে পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির বড় নমুনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলারের। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ড্যাশবোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, রফতানিকারকরা গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানির ঘোষণা (ইএক্সপি) দিয়েছেন ৪ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের। এ অনুযায়ী দুই সংস্থার গত অর্থবছরের রফতানি তথ্যে গরমিল রয়েছে ৯২৪ কোটি (৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন) ডলারের। ইপিবি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রফতানি তথ্যে বরাবরই গরমিল থাকলেও গত অর্থবছরেই তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
রফতানি তথ্যের এ বড় ব্যবধান এখন ভাবিয়ে তুলেছে নীতিনির্ধারকদেরও। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ১০ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে ‘রফতানি পরিসংখ্যানে গরমিল দূরীকরণ’ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গত অর্থবছরসহ রফতানি তথ্যের ধারাবাহিক গরমিলের পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে ২০১৮ সালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে এনবিআরের অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ স্থাপিত রয়েছে। ব্যাংকগুলো ড্যাশবোর্ডে যে রফতানির ঘোষণা দেবে, সেটিই পণ্য রফতানি হিসেবে গণ্য হবে। এর মধ্যে পুনঃরফতানি ও পণ্যের নমুনা বা স্যাম্পল রফতানির মতো নন-ব্যাংকিং চ্যানেলের তথ্য বাদ যাবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের রফতানির ঘোষণার চেয়ে বেশি অর্থমূল্যের পণ্য রফতানির সুযোগ তেমন একটা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে ইপিবির রফতানি তথ্যের পার্থক্যের একাধিক কারণ থাকলেও রফতানি তথ্যের এত বড় ব্যবধানকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা।
রফতানিকারকদের ভাষ্যমতে, অসাধু বাণিজ্যিক চর্চার কারণেও পরিসংখ্যানে ভিন্নতা দেখা যেতে পারে। বিশ্বের অন্য অনেক স্থানের মতো বাংলাদেশেও অর্থ পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পণ্য রফতানি করে অর্থ দেশে না আনার অভিযোগ রয়েছে অনেক। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এর পরও নানা ফাঁকফোকর গলে এমন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যাংকের নজরদারি ব্যবস্থা আরো শক্ত হওয়া প্রয়োজন। যে কারণই থাকুক না কেন, পরিসংখ্যানগত ভিন্নতার বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আপনার মতামত জানানঃ