দিল্লিতে সম্প্রতি যে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন হয়ে গেল, সেই উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটা স্মরণিকা গ্রন্থে মুঘল সম্রাট আকবরের গুণগান করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা নানা ভাবে মুঘল আমল সহ পুরো মুসলমান শাসনামলের ইতিহাস ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করে।
তাই মুসলমান শাসকদের মধ্যে একমাত্র আকবরের উল্লেখ এবং তার প্রশংসা দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন তাহলে কী আকবরের সম্বন্ধে নিজেদের মনোভাব পরিবর্তন করছে বিজেপি?
ওই স্মরণিকায় খ্রিষ্টপূর্ব ছয় হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, রামায়ণ-মহাভারত, গৌতম বুদ্ধের আমল সহ ভারতের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের টুকরো টুকরো ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
কী লেখা হয়েছে আকবর সম্বন্ধে?
‘ইন্ডিয়া: মাদার অব ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক গ্রন্থে ভারতের প্রাচীন সভ্যতা, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, ধর্ম, সাধু-সন্ত, বিভিন্ন মহাপুরুষ ও শাসকদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শাসকদের মধ্যে রামায়ণে উল্লিখিত রাম, মগধের অজাতশত্রু, মুঘল সম্রাট আকবর এবং ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সমস্ত প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে।
ওই বইতে মুঘল সম্রাট আকবরের পরিচয় দিয়ে লেখা হয়েছে “সুশাসন হল সেটাই, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণ হবে। তৃতীয় মুঘল পাদিশাহ আকবর সেই গণতন্ত্রেরই চর্চা করতেন।“
তার সম্বন্ধে স্মরণিকা গ্রন্থে আরও লেখা হয়েছে, তিনি ‘সুলহ-এ-কুল’, অর্থাৎ সার্বজনিক শান্তির নীতি নিয়ে চলতেন। এই নীতি ছিল ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে।“
লেখা হয়েছে আকবর এমন এক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে সৌহার্দ্য বিরাজ করবে, সেজন্যই তিনি নতুন ধর্ম ‘দিন-ই-ইলাহি’র প্রচলন করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ইবাদতখানা, যেখানে নানা ধর্ম আর বর্গের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা একসঙ্গে বসে তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন। উল্লেখ করা হয়েছে আকবরের নবরত্ন সভারও।
শেষে বলা হয়েছে আকবরের গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ছিল ব্যতিক্রমী এবং সময়ে থেকে অনেক এগিয়ে থাকা।
শুধু আকবরেরই উল্লেখ কেন?
ভারতের প্রাচীণ ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রচেষ্টার মধ্যে মুঘল সম্রাট আকবরের উল্লেখ অনেককেই বেশ বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে যখন অনেক বিজেপি নেতা আকবর সহ মুঘল শাসকদের সমালোচনাই করে থাকেন, সেখানে বিশ্বনেতাদের সামনে আকবরকে তুলে ধরা হল।
ঘটনাচক্রে আকবরের যে ‘সুলহ-এ-কুল’ নীতির গুণগান করা হয়েছে এই বইটিতে, সেই নীতিটার প্রসঙ্গ স্কুল সিলেবাস থেকে ছেঁটে ফেলার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে আরএসএসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তাথ্যিক নেতা দীননাথ বাত্রা নিজেই তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে চিঠি লিখেছিলেন।
এবছর এপ্রিল মাসে জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ পর্ষদ, এনসিইআরটি দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল আমলটাই সরিয়ে দিয়েছে।
হিন্দুত্ববাদের গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছেন যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক প্রয়োজন না থাকলে ওই পুস্তিকায় আকবর হয়তো জায়গা পেতেন না।
“এই পুস্তিকাটিতে ৫২টি পৃষ্ঠার মধ্যে ভারতের মুসলমান শাসনকালকে যে কয়েক পাতা জায়গা দেওয়া হয়েছে, তার মূল কারণ জি-২০ সম্মেলনে সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতি।
“প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো যুবরাজের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছেন আর সৌদি-ভারত বন্ধুত্বের কথা বলেছেন। ভারত সৌদি আরবকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় বলেই বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার নবী সংক্রান্ত মন্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে অনেক দিন পরে হলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিল দল।”
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলছেন যে জি-২- শীর্ষ সম্মেলনে শুধু সৌদি আরব নয়, তুরস্ক সহ একাধিক আফ্রিকান দেশও ছিল যেখানে ইসলাম প্রধান ধর্ম। সরকার নির্বাচনের আগে বিশ্বনেতাদের সামনে সংখ্যালঘুদের একটা বার্তা দিতে চাইছে বলেই তার মনে হচ্ছে।
“রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিজেপির কোনও মুসলিম মুখ নেই। আগামী নির্বাচনেও মুসলিম প্রার্থীদের টিকিট নাও দিতে পারে বিজেপি। কিন্তু জি-২০ ছিল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সুতরাং সেখানে এমন একটা ছবি তুলে ধরার দরকার ছিল, যাতে মনে হয় এখানে ইনক্লুসিভ রাজনীতি চলে।”
অন্যদিকে বিজেপি নেতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছেন, কূটনৈতিক বার্তা দেওয়ার জন্য আকবরকে ওই গ্রন্থে জায়গা দেওয়া হয়েছে, এটা অপব্যাখ্যা।
তার কথায়, “বিজেপি কখনই মুসলমান আমলকে সম্পূর্ণভাবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে না। ভারতের ইতিহাস চর্চা নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে ঠিকই, বিশেষত বামপন্থীরা যেভাবে সত্যটাকে নিজেদের মতো করে ঘুরিয়ে দিয়ে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেন। আমাদের আপত্তি সেখানে।
“আকবরের শাসনব্যবস্থার মধ্যে যদি কোনও ভাল দিক থাকে, সেগুলো তুলে ধরব না কেন? ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে তার সুশাসনের দিকগুলো যেভাবে গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে, তার গুরুত্বটাকে অস্বীকার কেন করব?”
তার কথায়, “এটা তো সত্যি যে আওরঙ্গজেবের তুলনায় সম্রাট আকবর অনেকাংশেই ভাল শাসক ছিলেন, যদিও তারও সাম্রাজ্যবাদী রূপ ছিল, রাণা প্রতাপের সঙ্গে তার দীর্ঘ দ্বন্দ্ব হয়েছিল তা নিয়ে তো দ্বিমত নেই। আবার এটাও ঠিক যে রাণা প্রতাপ সাহসের সঙ্গে লড়েছিলেন। এগুলো তো ইতিহাসের অংশ। বিজেপি ইতিহাসকে অস্বীকার করে না, ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যাটাকে অস্বীকার করে।“
বিজেপি নেতাদের মুঘল বিরোধী বক্তব্য
বিজেপি ইতিহাসকে অস্বীকার করে না বলে অধ্যাপক নন্দ দাবি করলেও মুঘল সম্রাটদের, এমনকি সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে দলের শীর্ষ নেতাদের।
গত মাসে মধ্যপ্রদেশে সন্ত রবিদাস মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “যখন আমাদের বিশ্বাসের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল এবং আমাদের পরিচয় মুছে ফেলার জন্য আমাদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তখন সন্ত রবিদাস দৃঢ় থেকেছেন। সেই যুগে মুঘলদের আধিপত্য ছিল।“
আবার চলতি বছরের জুন মাসে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরে যখন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তখন মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের ‘আওরঙ্গজেব কি আওলাদ’ মন্তব্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিংও একবার বলেছিলেন যে ইতিহাসবিদরা মহারানা প্রতাপের প্রতি অবিচার করেছেন। আকবরকে মহান বলা হয়, কিন্তু মহারানা প্রতাপকে কেন মহান বলা হয় না? রাজনাথ সিং বলেছিলেন যে মহারানা প্রতাপ একজন জাতীয় বীর ছিলেন।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে আকবর একজন আক্রমণকারী ছিলেন এবং আসল নায়ক হলেন মহারানা প্রতাপ।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের ৩৫০ তম বার্ষিকীতে যোগী আদিত্যনাথ ভারতীয় নৌবাহিনী যে শিবাজীর প্রতীক গ্রহণ করেছে, তার প্রশংসা করে বলেছিলেন যে মুঘলদের সাথে ভারতীয়দের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না।
এই কারণেই নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য শিবাজীর প্রতীকটি বেছে নিয়েছিল বলেও তিনি তখন জানান। যোগী আদিত্যনাথ তাজমহলের কাছে নির্মিত মুঘল জাদুঘরের নাম পরিবর্তন করে ছত্রপতি শিবাজী জাদুঘর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইতিহাসের বই থেকে মুঘলদের অধ্যায় বাদ
এবছর এপ্রিল মাসে জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ পর্ষদ বা এনসিইআরটি দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কিত পরিচ্ছেদটি সরিয়ে দেয়।
এনসিইআরটি দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের বই ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ শিরোনামে তিনটি অংশে প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় অংশের নবম পরিচ্ছেদ – ‘রাজা ও ইতিহাস, মুঘল দরবার’ বইটির আগের সংস্করণে থাকলেও এখন এনসিআরটির ওয়েবসাইটে বইটি ডাউনলোডের যে লিঙ্ক রয়েছে, সেখানে মুঘল শাসকদের উপর ২৮ পৃষ্ঠার অধ্যায়টি নেই।
ভারতের প্রাক্তন মুসলিম শাসকদের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়ার এনসিইআরটি-র পদক্ষেপকে ভারতীয় ইতিহাস থেকে মুঘলদের মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা হচ্ছে।
এনসিইআরটি অবশ্য যুক্তি দিয়েছিল যে শিক্ষার্থীদের ওপর পাঠ্যক্রমের বোঝা কমানোর জন্যই এমনটা করা হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ