আরও দুটি ধারা জামিনযোগ্য করে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আজ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখন কারিগরি ধারা ছাড়া খসড়া আইনের আর কোনো ধারা অজামিনযোগ্য নেই।
সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন করছে। ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়।
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে অংশীজন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ ছিল, আইনে সাজা কিছু কমানো ও ধারা জামিনযোগ্য করা ছাড়া বিষয়বস্তুতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এতে মানুষের হয়রানি কমাবে না।
৯ আগস্ট আইনটির খসড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়। এ জন্য তারা ১৪ দিন সময় দিয়েছিল। প্রায় ৫০০টি মতামত জমা পড়ে।
মন্ত্রিসভায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের আগে খসড়া আইনের বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে কি না, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
দুই আইনের তুলনা
বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পাঁচ বছর পর সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মূলত বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের।
এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন, সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে।
এই খসড়ার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই আইনের মধ্যে পরিবর্তন বলতে প্রথমত শাস্তি কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (৩৩ ও ৫৭) প্রস্তাবিত আইনে একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই দুই ধারায় প্রথমটিতে ‘বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর ইত্যাদির দণ্ড’ সম্পর্কে বলা আছে। আর দ্বিতীয়টিতে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম’ সম্পর্কিত অপরাধের কথা বলা আছে।
নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। এখন প্রস্তাবিত আইনে এ ক্ষেত্রে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। আর দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে এই দুটি ধারা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে সংস্থাটি যে আটটি ধারা (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) সংশোধনের কথা বলেছিল, তার ছয়টিতে পরিবর্তন (মূলত সাজা এবং জামিনের ক্ষেত্রে) করা হয়েছে।
দুটি ধারা বাতিলের দাবি ছিল, কিন্তু হয়নি
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে আগের মতোই বিষয়বস্তু হুবহু বহাল রাখা হয়েছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। প্রস্তাবিত আইনে শুধু সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড আগের মতোই ১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন বা ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। প্রস্তাবিত আইনে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। নতুন আইনেও এটি রয়েছে, বিষয়বস্তুর অস্পষ্টতা দূর করা হয়নি।
এই ধারায় অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় হবে।
প্রস্তাবিত সাইবার আইনকে নতুন মোড়কে পুরোনো কালো আইন বলেই মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। এটা অনেকটাই লোকদেখানো। এ ধরনের আইনের মাধ্যমে আমরা নজরদারিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি।’
এসডব্লিউএসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ