সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বন্দরনগরীকে রক্ষা করতে ১৯৯১ সালের বন্যা-পরবর্তী সময়ে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরই অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের জুনে পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধের ওপর ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করে সিডিএ।
প্রকল্পটির কাজ শেষ না হলেও ২০২১ সাল থেকে এ সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। তবে নগরীর সুরক্ষার জন্য এ প্রকল্প নেয়া হলেও বর্তমানে এটি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সংযোগ না থাকায় সামনের বছরগুলোয় রিং রোডটি জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অভিযোগ উঠেছে, সিটি আউটার রিং রোডের ১১টি স্লুইসগেট স্থাপন করা হলেও সেগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে পানি যাওয়ার পথ অনেকটা অকার্যকর। চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে একসময় ৫৭টি খাল ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব খালের অধিকাংশই দখল, ভরাট ও দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে এসব খাল খননের কথা থাকলেও সেগুলো ভূমি জটিলতায় আটকে রয়েছে। যে কারণে আউটার রিং রোডের সঙ্গে খালগুলোর কার্যকর সংযোগ তৈরি না হওয়ায় শহরের অভ্যন্তরীণ পানিপ্রবাহ বর্তমানে ও ভবিষ্যতে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
২০১৮ সালে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এ সংকটের কথা। নির্মিত স্লুইসগেটগুলো ভূমি থেকে উঁচু এবং স্লুইসগেটগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান খালগুলোর সংযোগ না থাকায় শহরের অভ্যন্তরীণ পানি সমুদ্রে বের হয়ে যেতে পারবে না বলে মন্তব্য করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
তবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তের জলাবদ্ধতা বা বন্যার জন্য রিং রোড দায়ী হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সিডিএর চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটিকে আরো বেশি কার্যকর করতে নতুন একটি ইন্টারসেকশন করা হচ্ছে। এসব কাজ শেষ করার পর অভ্যন্তরীণ খালের সঙ্গে স্লুইসগেটের সংযোগ ও বন্যা বা জলাবদ্ধ পানি নির্গমনের সংকট কেটে যাবে।’
আউটার রিং রোড প্রকল্প নেয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলেন, পতেঙ্গা অঞ্চলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রয়েছে। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সাম্প্রতিক নির্মীয়মাণ টানেল, দেশের প্রধানতম রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি পরিশোধন কারখানা, সবগুলো জ্বালানি বিতরণকারী কোম্পানির রিজার্ভার, চিটাগং রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (সিইপিজেড), কর্ণফুলী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (কেইপিজেড), নেভাল একাডেমি, চট্টগ্রামের একাধিক ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার, জেলারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি, ইস্টার্ন কেবলস, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল), বেসরকারি একাধিক বৃহৎ সিমেন্ট কারখানা ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বহু শিল্প-কারখানা রয়েছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘পতেঙ্গা অঞ্চলে চট্টগ্রামের শিল্পসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। অবাধ নগরায়ণের কারণে উন্মুক্ত স্থান যেখানে প্রাকৃতিকভাবে পানি ধারণ করা যাবে, সেগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে। আবার চট্টগ্রামের সব খালই দখল, দূষণে সরু হয়ে গেছে। ফলে চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পটির মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানো গেলেও চট্টগ্রামের জন্য বন্যা ও জলাবদ্ধতার নতুন সংকট তৈরি করবে।’
রিং রোড বা বাঁধ দিয়ে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ একটি পুরনো পদ্ধতি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি ব্যর্থ মেথডও।
এ ধরনের প্রকল্প সুফলের চেয়ে ভোগান্তিই বেশি বয়ে এনেছে। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী কোনো অঞ্চলে বাঁধ দিয়ে জলোচ্ছ্বাস-বন্যা আটকে রাখা যায়নি। এটা একটা ব্যর্থ উদ্যোগ। ফলে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা তো পাবেই না উল্টো দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তিতে ফেলে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের নাগরিকদের।’
একই কথা বলেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত রিং রোড প্রকল্প চট্টগ্রামবাসীর ভোগান্তি আরো বাড়াবে বলেই মনে করছি। পাহাড়ি ঢল কিংবা প্রবল বর্ষণের কারণে আকস্মিক বন্যা হলে রাস্তার এপাশের পানি ওপাশে যেতে পারবে না। অন্যান্য কোস্টাল এলাকায় নির্মিত বাঁধের বেলায় আমরা যেটা দেখেছি এখানেও তাই ঘটতে যাচ্ছে। এপাশের পানি দীর্ঘ সময় আটকে থাকবে। স্লুইসগেটগুলো রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে সমস্যা আরো জটিল হবে। তাছাড়া বিদ্যমান স্লুইসগেটের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।’
সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প গ্রহণের আগে পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিল। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির পানি চট্টগ্রাম শহরে অনুপ্রবেশ রোধে ষাটের দশকে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সাগরে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নব্বইয়ের দশকে বাঁধটির পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাঁধটির অবস্থা ক্রমেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল।
এ সংকট নিরসনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। উপকূলীয় এই রিং রোডটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত বাঁধের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। বাস্তবায়নের পর প্রকল্পের দায়িত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পাশাপাশি সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত থাকবে।
নগরকে জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচানোর জন্য সব দেশেই এখন প্রাকৃতিক সমাধানকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কোনো এলাকায় দীর্ঘ বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি সিডিএ কর্মকর্তাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
তিনি বলেন, ‘রিং রোডটি যেভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে এতে চট্টগ্রামবাসীকে দীর্ঘমেয়াদি নগর দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে। ঢাকার চারপাশে বাঁধের ফলে ঢাকাকে বন্যা থেকে বাঁচানো গেলেও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির শিকার কিন্তু ঢাকাবাসী হচ্ছে। তবে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামকে মেলানো যাবে না। সেখানে বাঁধ দিয়ে বা রিং রোড দিয়ে কি পাহাড়ি ঢল আটকে রাখা সম্ভব? পানি কোনোভাবেই আটকানো যায় না। এটা এক জায়গায় বাধা পেলে আরেক জায়গা দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে ভায়াডাক্ট পদ্ধতির রোড নির্মাণ বেশ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এভাবে লম্বা বাঁধের মতো সড়ক সামনের বছরগুলোতে নগরের বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করবে।’
জানা যায়, চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পটি ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুনে শেষ করতে ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার প্রথম সংশোধন প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন হয়। পরবর্তী সময়ে ওয়েব ডিটেকটেড ওয়াল, দুই লেনের স্থলে চার লেন সড়কে উন্নীত করা ছাড়াও সিসি ব্লক দিয়ে ব্লকিংসহ বিভিন্ন কাজ বর্ধিত করে প্রকল্পের আকার বাড়ানো হয়।
২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকল্পটির ব্যয় অনুমোদন হয় ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং সময় বেড়ে হয় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। চতুর্থ সংশোধনীতে ব্যয় ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ১৯ লাখ ৪১ হাজার থেকে আরো ৬৭৩ কোটি ২৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা বাড়ানো হচ্ছে। চতুর্থ সংশোধনীতে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে।
এসডব্লিউএসএস০৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ