কয়লা সংকটের কারণে গত ৩০শে জুলাই রবিবার ভোর থেকে পুনরায় বন্ধ হয়ে যায় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। কারিগরি ত্রুটি কাটিয়ে উৎপাদনে আসার ১০ দিনের মাথায় ফের বন্ধ হল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এনিয়ে গত সাতমাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সাতবার বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে চারবার বন্ধ হয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে, তিনবার কয়লার অভাবে। চলতি জুলাই মাসে প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ ছিল এর বিদ্যুৎ উৎপাদন।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) বলছে, এবারে ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে দেরি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ রামপালের উদ্দেশে ইন্দোনেশিয়া ছেড়েছে। সেই সাথে আরও দুটি জাহাজ আরও কয়েকদিনের মধ্যে রওনা দিবে বলে জানানো হয়। আগামী ৮ই অগাস্টের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুনরায় উৎপাদনে ফিরবে বলে তারা আশা করছেন।
এ ব্যাপারে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, “কয়লার জন্য পর পর এলসি খুলতে হয়। এরমধ্যে কোন এলসি খুলতে দেরি হলে সেটা চেইন রিয়্যাকশনের মতো কাজ করে। ডলার সংকটের কারণে সময় মতো এলসি খোলা একটা চ্যালেঞ্জ। এখনও অনেক বিল বকেয়া পড়ে আছে। এটা একটা জটিল সময়, তবে সাময়িক।”
এভাবে বিদ্যুৎ-কেন্দ্রটি ঘন ঘন বন্ধ ও চালু করতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বারবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়া নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেছেন, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র ঘন ঘন বন্ধ ও চালুর ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একবার বন্ধের পর চালু করতে দুই তিনদিন সময় লাগে। প্রতিবার চালু করতে বেশি পরিমাণে জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এতে খরচ বাড়ে। তাই এসব বড় কেন্দ্র সার্বক্ষণিক চালু রাখা প্রয়োজন।”
কয়লা-নির্ভর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিট আছে, যার প্রতিটি ৬৬০ মেগাওয়াটের। সে হিসেবে দুটি ইউনিট মিলিয়ে এই বিদ্যুৎ-কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে একটি ইউনিটে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় গত বছরের ১৭ই ডিসেম্বর। আগামী সেপ্টেম্বরের দিকে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হতে পারে।
পাওয়ার সেল বলছে, প্রথম ইউনিটের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট হলেও এটি দৈনিক গড়ে ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। প্রথম ইউনিটটি চালুর এক মাস না যেতেই চলতি বছরের ১৪ই জানুয়ারি প্রথম দফায় ডলার সংকটে কয়লা আমদানি জটিলতায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটির।
কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হলে এক মাসের মাথায় ফের কেন্দ্রটি চালু করা হয়। একই সংকটে গত ১৫ই এপ্রিল কেন্দ্রটি আবার বন্ধ করা হয়। তিনদিনের ব্যবধানে পুনরায় চালু করা হলেও ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় আবারও ২৩শে এপ্রিল বন্ধ হয়। ২৪ দিন বন্ধ থাকার পর ১৬ই মে রাতে কেন্দ্রটিতে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।
এরপর বিদ্যুৎ-কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ইউনিট প্রোটেকশনে ত্রুটি দেখা দিলে গত ৩০শে জুন আবার উৎপাদন বন্ধ হয়। ১০ দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার পর ১০ই জুলাই ত্রুটি সারিয়ে উৎপাদনে ফেরে। এর তিন দিনের মাথায় ১৩ই জুলাই আবার কারিগরি সমস্যার কারণে ৯ ঘণ্টার জন্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
আরও তিন দিন পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র বা টারবাইন ত্রুটির কারণে গত ১৬ই জুলাই থেকে বিদ্যুৎ-কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চারদিন ধরে মেরামত শেষে ২০শে জুলাই থেকে পুনরায় উৎপাদন শুরু হয়। এর ১০ দিন যেতে না যেতে আবারও বন্ধ হল উৎপাদন।
অর্থাৎ শুধু জুলাই মাসেই তিন বারের মতো বন্ধ হয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে বেশ লম্বা সময় এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ বন্ধ ছিল।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘন ঘন কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়ার কারণে এর যন্ত্রপাতির মান যাচাই করা জরুরি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-বিশেষজ্ঞ ম. তামিম।
কারিগরি সমস্যার মধ্যে আছে, টার্বাইনে ত্রুটি, বয়লার টিউব লিকেজ বা ফেটে যাওয়া, কুলিং হিটারে ছিদ্র দেখা দেওয়া, হাই প্রেশার স্টিম লিকেজ, অয়েল লিকেজ, গ্ল্যান্ডফিল লিকেজ ইত্যাদি।
তিনি বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি চালাতে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, রামপালে সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, ওই প্রযুক্তিকে সাপোর্ট দেয়ার মতো যন্ত্রগুলো যথেষ্ট মানসম্মত ও আধুনিক কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।”
“আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি, বয়লার টিউব ফেটে গিয়েছে। এখানে নকশায় সমস্যা থাকতে পারে। যন্ত্রাংশে সমস্যা থাকতে পারে। সুপার ক্রিটিক্যালের জন্য মানানসই দামী, মানসম্মত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করলে তো এমন হওয়ার কথা না।”
এ ব্যাপারে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানিয়েছেন, কোন বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নতুন চালু হলে একটা সময় পর্যন্ত এর ক্রুটিগুলো দৃশ্যমান হয় এবং সেগুলো ধাপে ধাপে সংশোধন করেই একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিতে হয়। আমরা সেই ওয়ারেন্টি পিরিয়ডে আছি।
তিনি বলেন,“যে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কোনো সময় বিভিন্ন ত্রুটি দেখা দিতে পারে, সেগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। রামপাল সেই পর্যায়টি অতিক্রম করছে।”
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার জানিয়েছেন, “প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চচাপ, উচ্চতাপ নিয়ে কাজ করে। তারমধ্যে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালনা একটু জটিল, এর প্রযুক্তি ভিন্ন বলে সমস্যাও বেশি হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কনফিগার করা লাগে। অনেক সময়ে কনফিগারেশনে সময় লেগে যায়।”
তাই এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘন ঘন কারিগরি ক্রুটি হওয়া বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা বেশ স্বাভাবিক বিষয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
এই কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রটির জ্বালানি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই কয়লা আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়ার বন্দর দিয়ে দেশে আসতে একটি জাহাজের ১০ থেকে ১২ দিনের মতো সময় লাগে। একটি জাহাজে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার মেট্রিক টন কয়লা পরিবহন করা যায়।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখতে প্রতিদিন ৫০০০ থেকে ৫৫০০ মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যে এক জাহাজ ভর্তি কয়লা দিয়ে বড়জোর ১০ দিন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা যাবে।
আগামী সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে তখন প্রতিদিন কয়লা প্রয়োজন হবে ১০ হাজার টন। সেক্ষেত্রে এই পরিমাণ কয়লায় দুটি ইউনিট চলবে মাত্র পাঁচ দিনে। যেখানে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টনের জোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা সরবরাহ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সারা বছর পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে ডলার-সংকটে কয়লার ঋণপত্র খুলতে যেন দেরী না হয় সেদিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। না হলে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না বলে তারা জানান।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, “বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত ডলার পেমেন্ট করে কয়লা আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মাণের সুফল মানুষ পাবে না।”
এই প্রকল্প ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে হওয়ায় দুই দেশের প্রকৌশলীরা মিলেই বিভিন্ন যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো সমাধানের চেষ্টা করে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার। এ ব্যাপারে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, ভারত বাংলাদেশ দুই দেশ এতে বিনিয়োগ করায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন যতোদিন বন্ধ থাকবে, সেই লোকসানের ভাগীদার দুই দেশের সমান সমান হবে।
এছাড়া যতো ধরণের যান্ত্রিক ক্রুটি হবে সেটার রক্ষণাবেক্ষণের খরচও দুই দেশ সমানভাবে ভাগে করে নেবে বলে তিনি জানান। এর আগে কয়লা আনার ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রামপাল বিদ্যুৎ-কেন্দ্রটি এমন সময় বন্ধ হয়েছে, যখন তাপমাত্রার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশে এই গরমের মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা সাধারণত ১৫ হাজার মেগাওয়াট হয়ে থাকে। কিন্তু সর্বোচ্চ উৎপাদন করা যাচ্ছে সাড়ে ১২ হাজারের মতো। ফলে পিকআওয়ারে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
এখন রামপাল বন্ধ থাকার কারণে আড়াই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির সাথে আরও অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি যুক্ত হল। যার কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মুখে পড়তে পারে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। সবশেষ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্ধ হওয়ার আগে এটি ৫০১ মেগাওয়াট থেকে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩৮২ মেগাওয়াটে নামিয়ে একসময় বন্ধ হয়ে যায়।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ