বৃক্ষের ইন্দ্রিয়ক্ষমতা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণাই পরিচালিত হয়েছে, তবে শব্দের প্রতি উদ্ভিদের সাড়া কেমন তা নিয়ে এখনো কোনো নির্ভরযোগ্য উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। উদ্ভিদের বাড়ন্তকালে সুর-সংগীত তাকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা নিয়ে অনেক কথাই আমরা শুনি, এরপরও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারা একটু অদ্ভুতই বটে।
গাছ ঘ্রাণ বা গন্ধ শুঁকতে পারে, এই ব্যাপারটি আমাদের যতটুকু আশ্চর্যান্বিত করে, গাছ শুনতে পায়, তা ভেবে আমরা ততটা অভিভূত হই না। বরং এটিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিই। ধ্রুপদি কিংবা আধুনিক গান শুনে ঘরের এক পাশে রাখা চারা গাছটির বড় হয়ে ওঠার গল্প আমরা অনেকেই শুনি।
তবে এ ধরনের অধিকাংশ গল্পই মূলত নবীন এবং আনাড়িদের হাতে হয়েছে বলে যথাযথ বৈজ্ঞানিক উপায়ে তদন্ত হয়নি।
অরণ্যের আদিপ্রাণ বৃক্ষ আদৌ শুনতে পায় কি না, তা বোঝার আগে আমাদের নিজেদের শ্রবণশক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। শ্রবণের সংজ্ঞা কী? কোনো নির্দিষ্ট একটি অঙ্গ, মানুষের ক্ষেত্রে কান, কম্পনকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে শব্দকে বোঝার যে সক্ষমতা অর্জন করে, সেটিই শ্রবণ।
বাতাসের মাধ্যমে এটি তরঙ্গমালা হয়ে চলাচল করে, কখনো জলে কিংবা স্থলমাধ্যমেও এটি চলাফেরা করতে পারে। কোনো কিছুকে আঘাত করার মাধ্যমে তরঙ্গের জন্ম (যেমন ঢোল পেটানো), কিংবা কম্পনের পুনরাবৃত্তি (যেমন গিটারর তারে টুংটাং); এখান থেকেই বাতাসে ছন্দ তৈরি হয়। আমাদের কানের অনেক ভেতর থাকা স্পর্শকাতর কোষ সেই শব্দে সাড়া দেয়।
এই কোষগুলো মূলত দুই ধরনের তথ্য বহন করে: প্রাবল্য (ভলিউম) এবং পিচ। প্রাবল্য শব্দটি শুনেই হয়তো পাঠক বুঝতে পারছেন যে এটি দিয়ে শব্দের প্রবলতা বা শক্তিকে বোঝানো হচ্ছে। তরঙ্গের উচ্চতাই এটিকে নির্ধারিত করে দেয়। যেমন সজোরে কোনো শোরগোলের প্রাবল্য বেশি, মৃদু শব্দের প্রাবল্য কম।
তরঙ্গের উচ্চতা বা শব্দের প্রাবল্য যত বেশি হবে, আমাদের অন্তঃকর্ণে থাকা সেই কোষ বা স্টেরিওসিলিয়াও তত বেঁকে যাবে। অন্যদিকে পিচ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে কতগুলো কম্পন হচ্ছে সেটিকে নির্দেশ করা হয়। ফ্রিকোয়েন্সি যত দ্রুত হবে, তত দ্রুত সেই কোষ বা স্টেরিওসিলিয়া নড়াচড়া করবে, পিচও তত বেশি হবে।
স্টেরিওসিলিয়া যখন কানে কাঁপতে থাকে, তখন সেখান থেকেই আবার শুরু হয় বিভিন্ন কার্যক্রম। সেটি আমাদের শ্রাবণিক স্নায়ুকে বার্তা পাঠায়, তা পৌঁছায় মস্তিষ্কে। সহজভাবে বললে, মানুষের শ্রবণের উৎপত্তি এবং গন্তব্য দুটি নির্দিষ্ট জায়গায়, আমাদের স্টেরিওসিলিয়া শব্দতরঙ্গ গ্রহণ করে এবং মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে যেন আমরা সেই অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি।
এখন প্রশ্ন হলো বৃক্ষের চোখ নেই, তবু তারা আলো চিহ্নিত করতে পারে; তাহলে তাদের কান না থাকা সত্ত্বেও কি তারা শুনতে পায়?
জীবনের কোনো একপর্যায়ে আমরা অনেকেই সুরের তালে বৃক্ষের সাড়া দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অভিভূত হয়েছি। এমনকি চার্লস ডারউইন নিজেও বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে খুঁজে দেখেছেন যে তিনি ওদের জন্য যে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, তা ওরা ধরতে পারত কি না।
বৃক্ষের দর্শনক্ষমতা নিয়েও ডারউইনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরবর্তী সময়ের বিজ্ঞানীদের পাথেয় হয়েছে। উদ্ভট পরীক্ষা চালাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মনে রাখা জরুরি যে আজীবন জীববিজ্ঞান-সম্পর্কিত গবেষণায় যেমন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি, পাশাপাশি বাঁশির প্রতিও তাঁর আলাদা মোহ ছিল।
তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে মিমোসাগাছের পাতাগুলোকে কি সেই বাঁশির আওয়াজে বন্ধ করা যায় নাকি, স্বাভাবিকভাবেই তা হয়নি। তিনি পরবর্তী সময়ে নিজের এই কাজকে ‘নির্বোধের নিরীক্ষা’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন।
অবশ্য ডারউইনের ব্যর্থ চেষ্টার পরপই বৃক্ষের শ্রবণশক্তি-সম্পর্কিত গবেষণা যে ‘ডালপালা’ গজিয়েছে, সেটি বলা যায় না। বিগত কয়েক বছরেই অসংখ্য বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বেরিয়েছে, যেখানে আলো, গন্ধ, স্পর্শের প্রতি উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা বলা হয়েছে, কিন্তু গত দুই দশকের ভেতরও নির্দিষ্টভাবে শব্দের প্রতি উদ্ভিদের সাড়া কেমন, তা নিয়ে কাজ হয়েছে সামান্য।
যেমন দ্য জার্নাল অব অল্টারনেটিভ অ্যান্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিনে প্রকাশিত একটা গবেষণাপত্রে এটি নিয়ে কাজ করেছেন ক্যাথরিন ক্রিথ এবং গ্যারি শোয়ার্টজ, তবে সে ক্ষেত্রে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা দিয়ে বৈধতা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ক্রিথ এবং শোয়ার্টজ নিজেদের এ গবেষণার ফলাফল সমর্থন করতে ডরোথি রিট্যালিকের ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক অ্যান্ড প্ল্যান্টস’-এর উল্লেখ করেছেন। রিট্যালিক নিজে পেশাদার গায়িকা ছিলেন; সিনাগগ ও চার্চে গান গাইতেন। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা থাকায় জীববিজ্ঞানে কিছু পড়াশোনা করে তিনি এই বই লিখেছিলেন।
উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সংগীত ঘরানার প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে, তিনি সমসাময়িকদের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে রক মিউজিক সম্ভবত ক্ষতিকর; স্রেফ গাছপালার জন্য নয়, মানুষের জন্যও। রিটাল্যাক বিভিন্ন উদ্ভিদ (ফিলোডেনড্রন, ভুট্টা, জেরানিয়াম) এবং বাখ, শোয়েনবার্গ, জিমি হেনড্রিক্স এবং লেড জেপেলিনের মিউজিক রেকর্ডিং ব্যবহার করেছিলেন।
প্রতিটি পরীক্ষায় ভিন্ন প্রজাতি ব্যবহার করে উদ্ভিদের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি দেখেছেন, নরম শাস্ত্রীয় সংগীতের সংস্পর্শে আসা উদ্ভিদের বৃদ্ধি লক্ষণীয়; এমনকি যখন তিনি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মুজাকের সুর শোনাচ্ছেন, তখনো। মুজাকের লিফট মিউজিকের সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত।
আবার যখন লেড জেপেলিন বা হেন্ড্রিক্সের ‘ব্যান্ড অব জিপসিস’ শোনানো হচ্ছে, তখন গাছগুলো তাদের বৃদ্ধিতে স্থবির ছিল। এটি দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল যে আসলে কিংবদন্তি ড্রামার জন বনহ্যাম এবং মিচ মিচেলের ড্রামবিট গাছপালাগুলোর ক্ষতি করছিল। রিটাল্যাক তাই পারকাশন, অর্থাৎ ড্রামবিট বন্ধ করে একই অ্যালবামের রেকর্ডিং চালিয়ে তাঁর পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
তিনি যেমনটা অনুমান করেছিলেন, ‘হোল লটা লাভ’ এবং ‘মেশিনগান’-এর ড্রামবিটসহ সংস্করণ শোনানোর পর তারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ড্রাম ছাড়া শোনানোর সময় ততটা হয়নি। এর অর্থ কি এটি হতে পারে যে উদ্ভিদের নিজস্ব পছন্দের বাদ্যযন্ত্র আছে, যা কাকতালীয়ভাবে রিটাল্যাকের সাথেও মিলে যায়?
তাহলে তো বিষয়টি উদ্বেগজনক, কারণ ফুল ভলিউমে জিমি হেন্ড্রিক্স এবং লেড জেপেলিনের গান শুনে অনেকের শৈশব-কৈশোর কেটেছে। অথচ রিটাল্যাক দেখাতে চাইলেন যে উঠতি বয়সের ‘অডিয়েন্সের’ জন্য রক মিউজিক কতটা ক্ষতিকর।
সৌভাগ্যবশত, সেই ৭০-এর দশকের জেপেলিন অনুরাগীদের জন্য, রিটাল্যাকের গবেষণাটি ছিল বৈজ্ঞানিক ত্রুটিতে পরিপূর্ণ। যেমন প্রতিটি পরীক্ষায় খুব অল্পসংখ্যক গাছপালা অন্তর্ভুক্ত ছিল (পাঁচেরও কম)। গবেষণায় প্রতিলিপির সংখ্যা এতই কম ছিল যে তা পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট না।
পরীক্ষামূলক নকশাটিও ছিল দুর্বল কিছু গবেষণা তাঁর বন্ধুর বাড়িতে করা হয়েছিল মাটির আর্দ্রতার মতো একটি প্যারামিটার আঙুল দিয়ে মাটি স্পর্শ করে নির্ধারিত হয়েছিল।
রিটাল্যাক তাঁর বইয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তবে তাদের প্রায় কেউই জীববিজ্ঞানী নন। তারা সংগীত, পদার্থবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ এবং বেশ কয়েকটি উদ্ধৃতি এমন উৎস থেকে এসেছে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণপত্র নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিটি হলো, রিটাল্যাকের গবেষণা কোনো নির্ভরযোগ্য ল্যাবে রেপ্লিকেট করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে উদ্বায়ী রাসায়নিক এবং উদ্ভিদের যোগাযোগের ওপর ইয়ান বল্ডউইনের প্রাথমিক গবেষণা শুরুতে মূলধারার একাডেমিয়ায় সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক ল্যাবে তা যাচাই এবং পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হয়েছে। অথচ রিটাল্যাকের এ গবেষণা পরবর্তী সময়ে আবর্জনা হিসেবেই পর্যবসিত হয়েছে।
অবশ্য তাঁর ফলাফল একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধে এসেছিল, একটি স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালে এই ফলাফল প্রকাশ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাও হয়েছিল এবং বইটি শেষমেশ নতুন যুগের সাহিত্য হিসেবে প্রকাশিতও হয়েছে। তবু এসব ঘটনা বইটির জনপ্রিয়তা পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তার ফলাফল ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও বিরোধিতা করেছে। নিউইয়র্ক বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্লেইন এবং পামেলা এডসাল, গাছপালা সত্যিই কি সংগীত দ্বারা প্রভাবিত কি না, তা নির্ধারণ করার জন্য বেশ কয়েকটি পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ভারতে সে সময় বেশ কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছিল যে সংগীত বিভিন্ন গাছপালায় অঙ্কুরিত শাখার সংখ্যা বাড়িয়েছে। সেসবের প্রত্যুত্তরেই এই প্রচেষ্টা। দাবি করা উদ্ভিদের একটি ছিল গাঁদা (ট্যাগেটস ইরেক্টা)। এটি যাচাই করার প্রয়াসেই, ক্লেইন এবং এডসাল গ্রেগরিয়ান মিউজিকসহ মোৎসার্টের সিম্ফনি, ডেভ ব্রুবেকের ‘থ্রি টু গেট রেডি’, বিটলসের গান ‘আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড’-এর সামনে গাঁদাকে উন্মুক্ত করেছিলেন।
ক্লেইন এবং এডসাল তাদের গবেষণা থেকে উপসংহারে পৌঁছেছেন যে সংগীত গাঁদাগাছের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে না। এখানে তাঁরা যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নিয়ে সামনে এগিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ক্লেইন এবং এডসালের গাঁদা ফুলগুলোর হয়তো রিটাল্যাকের গাছপালা থেকে ভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল।
অথবা খুব সম্ভবত, রিটাল্যাকের গবেষণায় পদ্ধতিগত এবং বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি থাকায় তা ফলাফলকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। ক্লেইন এবং এডসালের গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলেও সাধারণ জনগণের কাছে এটি দীর্ঘদিন অজানা-অদেখাই ছিল। অন্যদিকে ‘৭০-এর দশকে রিটাল্যাকের গবেষণা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
এমনকি পিটার টম্পকিন্স ও ক্রিস্টোফার বার্ডের ১৯৭৩ সালের সাড়াজাগানো বই, ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব প্ল্যান্টস’-এ উল্লিখিত হয়েছে, এটি ‘উদ্ভিদ ও মানুষের মধ্যে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সম্পর্কের আকর্ষণীয় বিবরণ’ উপস্থাপন করে। ‘দ্য হারমোনিক লাইফ অব প্ল্যান্টস’ শিরোনামে একটি খুব প্রাণবন্ত এবং সুন্দরভাবে লেখা অধ্যায়ে লেখকেরা জানিয়েছেন যে গাছপালা কেবল বাখ এবং মোৎসার্টকেই ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয় না, বরং পণ্ডিত রবি শঙ্করের ভারতীয় সেতার সংগীতের প্রতিও তাদের আগ্রহ রয়েছে।
বিখ্যাত উদ্ভিদ শারীরবৃত্তীয়, অধ্যাপক, এবং স্কেপ্টিক আর্থার গ্যালস্টন ১৯৭৪ সালে তাই লিখেছিলেন, ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব প্ল্যান্টস’-এর সমস্যা হলো যে এটি পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই প্রায় একচেটিয়াভাবে উদ্ভট দাবিগুলো নিয়ে এগোয়। কিন্তু ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব প্ল্যান্টস’-এর খ্যাতি অবশ্য তাতে থেমে থাকেনি।
তবে সাম্প্রতিককালে শব্দের প্রতি উদ্ভিদের কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া আছে এমন গবেষণালব্ধ তথ্য যৎসামান্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে যে সমস্ত নিবন্ধ বেরিয়েছে, তা থেকে দেখা যায় যে গাছপালা শুনতে পারে এমন ধারণাটিকে বারবার বাতিল করা হচ্ছে।
ফিজিওলজি অ্যান্ড বিহেভিয়ার অব প্ল্যান্টস-এ, গবেষক পিটার স্কট একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট করেছেন, ভুট্টা কি সংগীত দ্বারা প্রভাবিত কি না, সেটির গবেষণায় বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন।
বিশেষ করে মোৎসার্টের সিম্ফোনি কনসার্টেন্ট এবং মিট লোফের ‘ব্যাট আউট অব হেল’কে সংগীত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অবশ্য এসব গবেষণা থেকে একজন বিজ্ঞানীর নিজের মিউজিক টেস্ট সম্বন্ধেও অনেকটা জানা যায়। তবে প্রথম পরীক্ষায়, মোৎসার্ট বা মিট লোফের সুরের সংস্পর্শে আসা ভুট্টার বীজ নিঃশব্দে রেখে দেওয়া বীজের চেয়ে বেশি দ্রুত অঙ্কুরিত হয়েছিল। যারা দাবি করেন যে সংগীত গাছপালাকে প্রভাবিত করে, তারা এ গবেষণাকে সাধুবাদ জানাবেন।
পরেরবারও পরীক্ষা চলতে থাকে, কিন্তু এবার বীজকে গরম রাখার জন্য ছোট পাখা ব্যবহার করে বাতাস সঞ্চালন করা হলো। পরীক্ষার এই নতুন সেটে, নীরবে রেখে দেওয়া বীজ এবং সংগীতের সংস্পর্শে থাকা বীজের অঙ্কুরোদগম হারে কোনো পার্থক্যই ছিল না। এখানেই সঠিক পরীক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব।
বিজ্ঞানীরা প্রথম সেটের পরীক্ষায় আবিষ্কার করেছিলেন যে সংগীত বাজানো স্পিকারগুলো মূলত তাপ বিকিরণ করেছিল, সেটিই উদ্ভিদের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে; মোৎসার্ট বা মিট লোফের মিউজিক নয়, বরং তাপই ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে, আমরা আবার রিটাল্যাকের উপসংহারটি দেখি যে রক মিউজিকের তীব্র ড্রামবিট গাছপালা (এবং মানুষের জন্যও) ক্ষতিকর। ‘ড্রামিংয়ের কারণে গাছপালার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে’ তাহলে এর বিকল্প, বৈজ্ঞানিকভাবে বৈধ ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
প্রকৃতপক্ষে, জ্যানেট ব্রাম এবং ফ্রাঙ্ক স্যালিসবারি দুজনই স্পষ্টভাবে এর উত্তর দিয়েছেন। দেখিয়েছেন যে উদ্ভিদকে একাধিকবার স্পর্শ করলেও তার বামনত্ব হতে পারে, এমনকি উদ্ভিদ মারাও যেতে পারে। যেমনটি রিটাল্যাকের পরীক্ষায় পাওয়া গেছে। হয়তো এমন না যে গাছপালা রক মিউজিক পছন্দ করে না; হয়তো তারা দুলতে পছন্দ করে না। দুঃখজনক হলেও অন্য কিছু প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত, সমস্ত প্রমাণ আমাদের বলছে যে গাছপালা প্রকৃতপক্ষে ‘বধির’। আবার মানুষের মধ্যে যে জিন বধিরতা সৃষ্টি করে, উদ্ভিদেরও ঠিক একই জিন রয়েছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় ২০০০ সাল। সে বছর অ্যারাবিডোপসিস থালিয়ানার জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের জানানো হয়েছিল এবং সবাই ফলাফল শুনতে আগ্রহী ছিল। আনুমানিক ১২০ মিলিয়ন (১২ কোটি) নিউক্লিওটাইডের ক্রম নির্ধারণ করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বায়োটেকনোলজি কোম্পানির তিন শতাধিক গবেষক চার বছর ধরে কাজ করেছেন।
মূলত এটিই অ্যারাবিডোপসিসের ডিএনএ তৈরি করে। খরচও হয়েছিল প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পের পেছনে ব্যয়কৃত অর্থ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখনকার দিনে অভাবনীয় কারণ, প্রযুক্তি এতটা এগিয়ে গেছে যে মাত্র দুয়েক সপ্তাহের ভেতর একটি ল্যাব একাই মূল খরচের এক শতাংশেরও কম খরচে অ্যারাবিডোপসিস জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারে।
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন জিনোম সিকোয়েন্সিং করার জন্য অ্যারাবিডোপসিসকে প্রথম উদ্ভিদ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। বিবর্তনের কারণে অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় এর ডিএনএ তুলনামূলকভাবে কম। যদিও অ্যারাবিডোপসিসে বেশির ভাগ গাছপালা এবং প্রাণীর মতো প্রায় একই সংখ্যক জিন (পঁচিশ হাজার) উপস্থিত, এতে ননকোডিং ডিএনএ নামক ডিএনএ খুব কম থাকে, তাই এর ক্রম নির্ধারণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
ননকোডিং ডিএনএ পুরো জিনোমের মধ্যে পাওয়া যায়, এটি ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে এবং জিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন। আসুন, আরেকটু বৃহৎ পরিসরে ভাববার চেষ্টা করি। অ্যারাবিডোপসিসে ১২০ মিলিয়ন নিউক্লিওটাইডে প্রায় পঁচিশ হাজার জিন রয়েছে, গমের ১৬ বিলিয়ন নিউক্লিওটাইডেও একই সংখ্যক জিন রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে প্রায় বাইশ হাজার জিন রয়েছে, এটি অ্যারাবিডোপসিসের চেয়ে কম। তবে এতেও ২.৯ বিলিয়ন নিউক্লিওটাইড।
অ্যারাবিডোপসিসের ছোট জিনোম, ছোট আকার এবং দ্রুত উৎপত্তির কারণে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এটি সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা উদ্ভিদ হয়ে উঠেছিল। ফলস্বরূপ, এই আগাছার ওপর গবেষণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির দিকে আমাদের পরিচালিত করেছে।
অ্যারাবিডোপসিসে পাওয়া ২৫ হাজার জিনের প্রায় সবই কৃষি এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ যেমন তুলা এবং আলুতে উপস্থিত। অর্থাৎ এতে চিহ্নিত যেকোনো জিন (ধরুন, নির্দিষ্ট উদ্ভিদ আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী জিন) অন্য একটি ফসলে তার ফলন উন্নত করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার করা যেতে পারে।
অ্যারাবিডোপসিস এবং মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং বেশ কিছু আশ্চর্যজনক ফলাফল হাজির করেছে। যেমন অ্যারাবিডোপসিস জিনোমে কয়েকটি জিন রয়েছে, যা মানুষের রোগ এবং অক্ষমতার সাথে জড়িত বলে পরিচিত। অন্যদিকে মানব জিনোমে উদ্ভিদের বিকাশে জড়িত বলে পরিচিত বেশ কয়েকটি জিন রয়েছে, যেমন ঈঙচ৯ সিগন্যালোসোম নামক জিনের একটি গ্রুপ, যেটি উদ্ভিদের আলোতে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
বিজ্ঞানীরা অ্যারাবিডোপসিস ডিএনএ সিকোয়েন্সের পাঠোদ্ধার করার সাথে সাথে আবিষ্কার করেছেন যে এই জিনোমে বিআরসিএ জিন (যা ক্যানসারের জন্য দায়ী), সিএফটিআর জিন (যা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের জন্য দায়ী), এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার সাথে জড়িত বেশ কয়েকটি জিন রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বনামধন্য অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে আপাদমস্তক ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ ব্যাপারটিই উদ্ভিদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এমন কি কোনো শব্দ আছে, যা অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া জানাতে সুবিধাজনক হতে পারে? ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ স্নায়ুবিদ্যার আন্তর্জাতিক ল্যাবরেটরির পরিচালক অধ্যাপক স্টেফানো মানকুসো সম্প্রতি টুস্কানি ওয়াইন অঞ্চলের একটি আঙুর বাগানের ফলন বাড়াতে শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করছেন। কিন্তু শব্দতরঙ্গের এ রকম ব্যবহারের পেছনের মৌলিক জীববিজ্ঞান এখনো অস্পষ্ট।
সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোমান জুইফেল এবং ফ্যাবিয়েন জিউগিন খরার সময় পাইন এবং ওকগাছ থেকে আল্ট্রাসনিক (শ্রবণাতীত) কম্পনের কথা জানিয়েছেন। এই কম্পন জল-পরিবহনকারী জাইলেম ভেসেলের জলের পরিবর্তনের ফলে ঘটে। অবশ্য এই শব্দশক্তির নিষ্ক্রিয় ফলাফল, যেমন একইভাবে পাহাড় থেকে শিলা পড়ে শব্দ হয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই শ্রবণাতীত কম্পন কি অন্যান্য গাছকে খরার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পূর্বাভাস দেয়? যদি বিজ্ঞানীরা শব্দতরঙ্গের প্রতি উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া সঠিকভাবে অধ্যয়ন করতে চান, তাহলে মনে রাখা জরুরি, উদ্ভিদের শ্রবণব্যবস্থা যদি বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরিও হয়, তবে তা প্রাণীর চেয়ে ভিন্নভাবেই হবে। সম্ভবত কিছু উদ্ভিদ ক্ষুদ্রাকৃতির শব্দ অনুভব করে।
এসব সম্ভাবনা চিন্তা করার জন্য আকর্ষণীয়, তবে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার আগপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই আমাদের থাকতে হচ্ছে যে গাছপালা বধির এবং বিবর্তনের সময় তারা এই অনুভূতি অর্জন করেনি। প্রখ্যাত বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী থিওডোসিয়াস ডবজানস্কি বলেছিলেন, ‘বিবর্তনকে বাদ দিয়ে জীববিজ্ঞানের কোনো কিছুকেই ব্যাখ্যা করা যায় না।’ এটি বিবেচনায় এনে, সম্ভবত আমরা বুঝতে পারি যে কেন অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের বিপরীতে শ্রবণ উদ্ভিদের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ না।
মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য শ্রবণের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিবর্তনীয় সুবিধা আমাদের দেহকে সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে। বিপজ্জনক শিকারি বনের মধ্যে তাদের তাড়া করছে, তা আদি মানব পূর্বসূরিরা শুনতে পেত। আমরাও কিন্তু গভীর রাতে নির্জন নিবু নিবু আলোর রাস্তায় কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কি না, সে জন্য অস্পষ্ট পদচিহ্ন লক্ষ করি।
শ্রবণশক্তি মানুষের সঙ্গে মানুষের কিংবা প্রাণীর মধ্যে দ্রুত যোগাযোগে সাহায্য করে। হাতি সাবসনিক তরঙ্গের মাধ্যমে বিশাল এলাকাজুড়ে একে অপরকে খুঁজে পায়, এটি মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করে। সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া ডলফিনকেও চিৎকারের মাধ্যমে তার দল খুঁজে পায় এবং এম্পেরর পেঙ্গুইনরা তাদের সংগীদের খুঁজে বের করার জন্য আলাদা নাম ব্যবহার করে।
উদাহরণগুলো দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, শব্দ মূলত তথ্যের দ্রুত যোগাযোগ এবং একটি সাড়া জাগানোর চেষ্টা করে, অধিকাংশ সময়ই সেটি হয় চলনের মাধ্যমে: যেমন আগুন,আক্রমণ থেকে পালানো, নিজের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া।
কিন্তু গাছপালা স্থির, শিকড় দিয়ে মাটিতেই তারা সুরক্ষিত। যদিও সূর্যের দিকে বাড়তে পারে, আবার অভিকর্ষের সাথে বেঁকে যেতে পারে, তারা পালিয়ে যেতে পারে না। তারা ঋতুর সাথে স্থানান্তর করে না। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশের মুখে নোঙর বাঁধা থাকে তাদের। মিমোসা এবং ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের গতিবিধি বেশ ধীরস্থির এবং সহসা মানুষের চোখে পড়ে না। তাই দ্রুত পশ্চাদপসরণ করার মতো যোগাযোগব্যবস্থার প্রয়োজন উদ্ভিদের নেই।
উদ্ভিদের জন্য শ্রবণ তাই অপ্রাসঙ্গিক। অরণ্যের এত শত কোলাহল উদ্ভিদের কাছে কোনো সাড়া জাগায় না। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে উদ্ভিদ পৃথিবীতে বিবর্তিত হয়েছে এবং প্রায় চার লাখ প্রজাতির গাছপালা কোনো শব্দ না শুনেই প্রতিটি বসতিকে জয় করে নিয়েছে। উদ্ভিদ হয়তো বধির, তবে তারা কোথায় আছে, কোন দিকে বেড়ে উঠছে এবং কীভাবে চলাফেরা করছে, তা নিয়ে তীব্রভাবে সচেতন। সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
এসডব্লিউএসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ