১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাইয়ের প্রথম প্রহর। বাঙ্কারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে বিশ্বকে বদলে দেওয়া মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। বাঙ্কার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে, নিউ মেক্সিকোর জর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরভূমিতে তখন বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চলছিল। যে পরীক্ষার কোডনেম ছিল ‘ট্রিনিটি’।
ওপেনহাইমারের মুখে তখন একই সাথে ক্লান্তি ও উত্তেজনার ছাপ। তিনি সবসময়ই ছিলেন পাতলা গড়নের মানুষ। কিন্তু ‘ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট’ এর পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প ‘প্রজেক্ট ওয়াই’ এর পরিচালক হিসেবে তিন বছর কাজ করার পর তার ওজন নেমে আসে ৫২ কেজিতে। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার একজনের জন্য যা অত্যন্ত কম। আগের রাতে কেবল চার ঘণ্টা ঘুমাতে পেরেছিলেন তিনি।
১৯৪৫ সালের সেই দিনটি ওপেনহাইমারের জীবনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি। সে সময়ের মার্কিন সেনাবাহিনীর এক জেনারেলের বর্ণনা তুলে ধরেন বার্ড ও শেরউইন। জেনারেল বলেন, কাউন্টডাউনের শেষ মুহর্তে ওপেনহাইমারের টেনশন বেড়ে যায়। বিস্ফোরণ সূর্যের আলোকে ছাপিয়ে যায়। ২১ কিলোটন টিএনটির সমান শক্তি উৎপন্ন করা বিস্ফোরণটি এখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে বড়। এটি এমন শকওয়েভ তৈরি করে, যা ১৬০ কিলোমিটার দূরে অনুভূত হয়েছিল। ওপেনহাইমারের মুখে তখন স্বস্তির ছায়া।
১৯৬০ এর দশকে এক সাক্ষাৎকারে ওপেনহাইমার তার প্রতিক্রিয়া জানান, বোমার পরীক্ষার সময় তার হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতার একটি পঙক্তির কথা মনে পড়ছিল। সে পঙক্তি ছিল- এখন আমিই হয়ে উঠেছি মৃত্যু, বিশ্ব ধ্বংসকারী।
দুই সপ্তাহ পর তারই সৃষ্টির কারণে জাপানের মানুষের পরিণতি নিয়ে হতাশ ছিলেন ওপেনহাইমার। সেই সময় এই পদার্থবিদ তীব্র আক্ষেপ করেছিলেন বলে জানান তারই এ বন্ধু। অবাক করা বিষয় হলো, হিরোশিমায় বোমা বিস্ফোরণের একদিন পর আবার কাজে নেমে পড়েন ওপেনহাইমার। পারমাণবিক বোমা কিভাবে আরো উন্নত করা যায়, বৃষ্টি কিংবা তুষারে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন তিনি।
এমনই এক বিভ্রান্তিকর ব্যক্তিত্ব ছিলেন ওপেনহাইমার। তাকে নিয়ে লেখা বইয়ের লেখক ও ঘনিষ্টজনরা তার চরিত্রের এই দিকটি নিয়ে বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া প্রথম দিকের এক জার্মান ইহুদি অভিবাসীর ঘরে ১৯০৪ সালে জন্ম ওপেনহাইমারের। টেক্সটাইল পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে তার পরিবার ধনী হয়ে ওঠে। এত ধনসম্পদপূর্ণ পরিবারে বেড়ে উঠলেও ওপেনহাইমারকে তার ছোটবেলার বন্ধুরা উদার প্রকৃতির বলেই মন্তব্য করেন।
৯ বছর বয়সেই গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় দর্শনশাস্ত্র পড়তে শুরু করেন ওপেনহাইমার। খনিজবিজ্ঞানের প্রতি ছিল তার বিশেষ ঝোঁক। তিনি নিউ ইয়র্ক মিনেরালোজি ক্লাবকে নিজের খুঁজে পাওয়া বিষয়বস্তু নিয়ে চিঠি লিখতেন। তাকে পূর্ণ বয়স্ক মনে করে একবার বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও ডাকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। বার্ড ও শেরউইন বলেন, সমবয়সীদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন ওপেনহাইমার। খেলাধুলায় তার আগ্রহ ছিল না। সমবয়সীদের সঙ্গে অংশগ্রহণ না করায় তাকে উত্যক্তও করা হতো ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়তে যাওয়ার পর ওপেনহাইমারের মানসিক সমস্যা প্রথমবার ধরা পড়ে। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার পরও এ অবস্থা চলতে থাকে। ওপেনহাইমার রসায়নের গবেষণাগারের কাজে দুর্বল ছিলেন। শিক্ষক তাকে সেখানেই কাজ করতে দেন। গবেষণাগারে কাজ করা নিয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলেন ওপেনহাইমার। তার মনে হতো সেখান থেকে কিছু শেখা যাচ্ছে না।
সে বিরক্তি এতদূর গড়ায় যে, ১৯২৫ সালে ওপেনহাইমার তার শিক্ষকের ডেস্কে ল্যাবের বিষাক্ত ক্যামিকেল মেশানো আপেল রেখে দেন। শিক্ষক তা খাননি। আর ওপেনহাইমার শিক্ষককে হত্যা নয়, মূলত ভয় দেখাতে এই কাজ করেছিলেন। এরপর তাকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই সময়কার কথা বর্ণনায় ওপেনহাইমার জানান, সে বছর তিনি ক্রিসমাসের ছূটিতে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। তবে মনোবিদরা ব্যর্থ হলেও ওপেনহাইমারকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে তোলে সাহিত্য। এসময় কবিতা আর উপন্যাসের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েন তিনি।
চলচ্চিত্রে টুপি পরা, চেইন স্মোকার রবার্ট ওপেনহাইমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিলিয়ান মারফি। ছবি: ইউনিভার্সাল ভিয়া বিবিসি
১৯২৬ সালের শুরুতে জার্মানিতে ইউনিভার্সিটি অভ গোটিনজেনের ইন্সটিটিউট অভ থিউরিটিক্যাল ফিজিক্সের পরিচালকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওপেনহাইমারের। পরিচালক তার প্রতিভা ধরতে পারেন। ১৯২৬ সালকেই ওপেনহাইমারের পদার্থবিজ্ঞানে আসার বছর বলে ধরে নেওয়া হয়। পরের বছরগুলোতে তিনি থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টোরাল শেষ করেন। সেখানে ওপেনহাইমারের সঙ্গে পড়ালেখা করা অনেকে পরে ম্যানহাটন প্রজেক্টে যোগ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের পেশাজীবন শুরু করেন ওপেনহাইমার। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মহাজাগতিক রশ্নি ও পারমাণবিক বিখন্ডায়ন নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীদের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করেন। তবে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পুরো বিষয়টি আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন।
১৯৩০ এর দশকের শুরুতে তিনি হিন্দু পুরান নিয়ে আগ্রহী হন। ভগবত গীতা পড়তে তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখেন। অভিজাত পরিবারের দুই পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধ থেকে নেওয়া শিক্ষা তিনি প্রজেক্টের ওয়াই এর সময় সৃষ্টি হওয়া নৈতিক অস্পষ্টতা মুক্তি পেতে প্রয়োগ করেন। তার অনুধাবন ছিল- পরিণতির ভয়ে নিষ্ক্রিয় থাকাকে যৌক্তিক বলা যাবে না।
এসময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় জেন টেটলকের । ওপেনহাইমার তার প্রেমে পড়ে যান। তবে টেটলক বারবার তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। জেন টেটলক তাকে পরিচয় করিয়ে দেন জন ডানের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে। ডানের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি বোমা পরীক্ষার কোডন্যাম দেন ট্রিনিটি।
১৯৪০ সালে প্রজেক্ট ওয়াই-এ সহকর্মী ক্যাথরিন কিটিকে বিয়ে করেন ওপেনহাইমার। ক্যাথরিনের দায়িত্ব ছিল বিকিরণের বিপদ নিয়ে গবেষণা করা।
১৯৩৯ সালে রাজনীতিবদদের আগেই সম্ভাব্য পারমাণবিক হুমকি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ওপেনহাইমার। পরবর্তীতে আইনস্টাইন বিষয়টিকে রাজনীবিদদের নজরে আনেন। প্রতিক্রিয়া ধীর গতির হলেও বিজ্ঞানীদের মধ্যে হুমকির বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদক্ষেপ নেন। ওপেনহাইমার ছিলেন সেসব বিজ্ঞানীদের একজন, যাদেরকে প্রথক দিকে পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে ওপেনহাইমার তার দলের সহায়তায় পারমাণবিক বোমার নকশা প্রস্তৃত করেন।
তাকে নেতৃত্ব দেওয়া হতে পারে এমন সম্ভাবনা জানার পর ওপেনহাইমার সমাজতান্ত্রিক দল থেকে নিজের সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সরকারের মধ্যেও এ বিষয়ে উদ্বেগ ছিল, তবে ওপেনহাইমারের জ্ঞান ও পারদর্শিতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের ভাবনায় পরিবর্তন আসে। তিনি পারমাণবিক বোমাাকে আগ্রাসন ও সন্ত্রাসের অস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেন। অস্ত্র তৈরিকে তিনি ‘শয়তানের কাজ’ বলেও মন্তব্য করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে ওপেনহাইমার বলেছিলেন, আমি অনুভব করছি যে আমার হাত রক্তে রঞ্জিত।
বোমা তৈরির সময় নৈতিক অস্পষ্টতা নিয়ে ওপেনহাইমার তর্ক করেছিলেন। তিনি তখন বলেন, বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের কাজ হলো নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। কিভাবে এটি ব্যবহার হচ্ছে সেটি বিবেচ্য নয়। কারো মৃত্যু হলে তার দায় রাজনীতিবিদদের। তবে পরে তার এই অবস্থান বদলে যায়।
১৯৫৪ সালে ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সরকার এবং তার নিরাপত্তা ছাড়পত্র (বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রয়োজনীয় অনুমোদন) বাতিল করা হয়। তবে তৎকালীন শিক্ষাবিদরা এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৬৩ সালে মার্কিন সরকার তাকে এনরিকো ফার্মি পুরস্কারে ভূষিত করে। কিন্তু ২০২২ সালে, ওপেনহাইমারের মৃত্যুর ৫৫ বছর পর গিয়ে তার নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৬৭ সালে এই পদার্থবিজ্ঞানী মারা যান। জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির পরিচালক হিসেবে কাটিয়েছেন। কাজ করেছেছেন আইনস্টাইন এবং অন্যান্য শীর্ষ পদার্থবিদদের সাথে। এই পুরো সময় তিনি একই সাথে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারার গর্ব ও তার সৃষ্টির প্রভাব নিয়ে অনুশোচনা করে কাটিয়েছেন।
এসডব্লিউএসএস/০৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ