বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে অবস্থান করছে, সেখানে রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ার কথা আয়কর। কিন্তু বর্তমানে আয়কর রাজস্ব আহরণের তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত হিসেবেই রয়ে গেছে। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সাপ্লিমেন্টারি ডিউটিসহ আমদানি শুল্কের অনেক পেছনে রয়েছে আয়কর থেকে অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ। রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ও কর-জিডিপির অনুপাত এত কম থাকলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণামে সরকারি ঋণ ক্রমে বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না।
বাংলাদেশেও ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমেই জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ প্রতিবছর বাড়াতেই হচ্ছে। ফলে ২০১৪ সালে আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেখানে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৪২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক রকমের বেশি হয়ে গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ অতি দ্রুত অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয়-বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ রাখতে হয়েছে সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে—মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষে এই খাতে প্রকৃত ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
আগামী বছরেই সুদ পরিশোধ খাতে সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ বর্তমান বাজেটের আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের নতুন অর্থবছরের শুরুটাই হলো ধার দিয়ে। রাজস্ব আয়ের বড় ঘাটতির কারণে সরকারের পরিচালন খরচ মেটানো হচ্ছে টাকা ছাপিয়ে। চলতি অর্থবছরের মাত্র ২০ দিন পার হলো। এরই মধ্যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, একদিকে মুদ্রানীতিতে টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল; অন্যদিকে সরকারি খরচ মেটাতে অবাধে টাকা ছাপানোর ফলে উল্টো মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়ার পথে হাঁটছে সরকার। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের আগুনে আবার ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল্যস্ফীতির দিক দিয়ে দেশ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। প্রায় দুই বছর ধরে জিনিসপত্রের দামে সাধারণ মানুষ অনেকটা দিশেহারা। বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমে এলেও ডলারের বাড়তি দামের কারণে এর সুফল পাচ্ছে না দেশের ভোক্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে। ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে টাকা খরচ কমে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখতেই এ কৌশল। অথচ সরকার ঠিকই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে নিজের খরচ মেটানোর পথে হাঁটছে। বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির কারণেই সরকারের টাকায় টান পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা জানান, সরকার যখন অন্য উৎস থেকে টাকা ধার না করে সরাসরি টাকা ছাপিয়ে খরচ মেটায়, তখন মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ে। অতি মূল্যস্ফীতির এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের দফায় দফায় টাকা নিয়ে খরচ করার ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা আরও কঠিন হবে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ নেয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। ঋণ গ্রহণে সরকারের প্রবণতা বছরজুড়েই ছিল। চলতি অর্থবছরেও তা অব্যাহত আছে। সরকারের ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটে, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথম ২০ দিনেই সরকার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে। আর বিদায়ী অর্থবছর পর্যন্ত নিয়েছে ৪ লাখ ৮৩০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয় ১ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে তা ছিল ৬২ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। সরকার অবশ্য ধারের টাকা থেকে আগের বছরগুলোর ধারের কিছু শোধও করে থাকে।
ব্যাংকাররা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়া এবং সঞ্চয়পত্রের আগের ঋণ পরিশোধ করতে হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে বছরের প্রথম দিক থেকেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে নতুন করে ঋণ নিতে হয়েছে। আবার বেশির ভাগ ঋণেরই জোগান এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিভল্বমেন্ট ফান্ড (নতুন টাকার জোগান) থেকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইতিপূর্বে একই অর্থবছরে ডিভল্বমেন্ট করে সরকারকে এত বেশি ঋণ কখনো দেওয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকটের কারণে চলতি অর্থবছর ডিভল্বমেন্টের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া বেড়েছে।
এ বিষয়ে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা অর্থনীতির ওপর খারাপ প্রভাব তৈরি করবে। সরকার চলতি অর্থবছর সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাপানোর চিন্তা করছে। এ জন্য তারা এভাবে ঋণ নিচ্ছে। তিনি বলেন, এতে সাময়িকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হলেও তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও খারাপ হবে।
জানা যায়, সরকার প্রতি রোববার ট্রেজারি বিল এবং মঙ্গলবার বন্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের জন্য নিলামের ব্যবস্থা করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিলামে বন্ড বা বিল কিনতে ব্যর্থ হলে তা ডিভল্বমেন্ট করা হয়। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন টাকার রিজার্ভ থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিভল্বমেন্ট ফান্ড থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের শুরুতে ছিল ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক অর্থবছরে সরকার টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে ১৪৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকার জোগান দেওয়ার তথ্যটি অস্বীকার করলেও নতুন টাকা ছাপানোর তথ্য গোপন থাকছে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২২ সালের মে মাসে দেশে মোট ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১ কোটি। গত মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাজারে জোগান বেড়েছে ৪৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতি অবলম্বন করছে, তাতে সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের উচিত মেগা প্রকল্প, বিদেশ ভ্রমণের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমানো। তা না করলে টাকা ছাপানো বন্ধ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর খেসারত দিতে হবে সাধারণ মানুষকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ