গ্রিক পন্ডিত অ্যারিস্টোটলের মতে, “গণিত হল পরিমাণের বিজ্ঞান। আবার জার্মান গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস এর মতে, ”গণিত হল সকল বিজ্ঞানের রাণী। গণিত বিজ্ঞানের ভাষা। এটি হলো গণিতের সার্বজনীন ভাষা। এ ভাষা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বা গণিতবিদগণ একে অপরের সাথে মতামত বিনিময় করে থাকেন।
গণিত ও সংখ্যাকে বলা হয় মহাজগতের ভাষা। গণিত আছে বলেই আমরা জগতের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা জানি। গণিতের যথার্থ ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি আধুনিক ও উন্নত সভ্যতা। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ গণনা করতে পারত না, হিসাব কষা তো দূরে থাক। তাহলে কালের ঠিক কোন দিগন্ত থেকে আবির্ভাব হলো সংখ্যার ধারণা। কে বা কারা প্রথম পরিচয় করিয়ে দিল গণিতের সঙ্গে, যার স্পর্শে পাল্টে গেল মানব সভ্যতার ইতিহাস?
আনুমানিক ৫৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বর্তমান ইরাকের দক্ষিণ অংশ তৎকালীন সময়ে মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত ছিল। মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দা ছিল সুমেরীয়রা, যেটাকে আমরা অনেকে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা নামে চিনি। তারা ছিল পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত ও শহুরে বসবাসকারী মানবসম্প্রদায়। দৈনন্দিন প্রয়োজন ও ক্রয়-বিক্রয়ের চাহিদা থেকে সেখানে গণনা করার রীতি প্রচলিত হয়। যেহেতু তখনো কেউ লিখিত পদ্ধতির প্রচলন শুরু করেনি, তাই তারা একধরনের মাটির তৈরি টোকেন উদ্ভাবন করে (দেখতে কিছুটা পেরেক আকৃতির) এবং প্রতিটি টোকেন দ্বারা একটি অঙ্ক বোঝানো হতো। শহুরে নাগরিকদের কর, রাজস্ব আদায়ের হিসাব-নিকাশ, পণ্যদ্রব্যের হিসাব, পশু গণনা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হতো এগুলো। এটাই ছিল গণিতের সূচনা।
এভাবে পেরিয়ে যায় প্রায় এক হাজার বছর। সুমেরীয় সভ্যতা ধীরে ধীরে কালের ধ্বংসলীলায় মিলিয়ে যেতে থাকে। নতুন সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটে আর সুমেরীয়দের অর্জিত জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে পরে দূরবর্তী নীলনদের কোল ঘেঁষে যাওয়া আরবের আরেক বিখ্যাত ভূখণ্ডে, যেটি আজকের মিসর। জ্ঞান পিপাসু মিসরীয়রা গণিত ভালোবাসত। প্রাচীন মিসরের শিশুরা বালুতে দাগ কেটে সংখ্যার কাল্পনিক প্রতিকৃতি একে খেলা করত। এই সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সুবিশাল ও মনোমুগ্ধকর অট্টালিকা নির্মাণের পারদর্শিতা। নিখুঁত ও সুন্দর স্থাপত্য নির্মাণের জন্য প্রয়োজন নির্ভুল পরিমাপ। আর নির্ভুল পরিমাপের জন্য প্রয়োজন সংখ্যার সঠিক হিসাব। হিসাব ও পরিমাপকে অপররে কাছে প্রকাশ করার জন্য তারা বিভিন্ন চিত্রলিপি যেমন বস্তু ও প্রাণীর প্রতিমূর্তি ব্যবহার করত, যার কিছু নমুনা মিসরিয়ান হায়ারোগ্লিপে পাওয়া যায়।
কাটল আরও কয়েক হাজার বছর। সুদূর গ্রিস থেকে এক বিদ্যানুরাগী মিসরে আসলেন অধ্যয়ন করতে। প্রাচীন গ্রিসের মানুষ তখন গণনা করতে শেখেনি। আরব বিশ্বের চেয়ে তারা কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে। বিদ্যানুরাগী সেই ব্যক্তিটি মিসরীয়দের প্রযুক্তি জ্ঞান দেখে অভিভূত হন। গণিতকে তিনি মনে প্রাণে ভালোবাসতে থাকেন এবং নিজ দেশ গ্রিসে ফিরে এসে গণিত শিক্ষার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হলেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাস মনে করতেন মহাবিশ্বের সব লুকায়িত সৌন্দর্যের রহস্য হচ্ছে সংখ্যা। তিনি লক্ষ্য করেন দুটি আলাদা বস্তুর ওজন যদি কাছাকাছি কোনো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হয় (যেমন ১: ২ অনুপাত ওজনের দুটি আলাদা মাটির পাত্র) তাহলে তাদের আঘাত করলে সাদৃশ্যপূর্ণ সুরেলা আওয়াজ উৎপন্ন হয়। সংগীতের এই মাধুর্যপূর্ণ ধ্বনির মিলনের পেছনে আছে সংখ্যার অপূর্ব বিন্যাস। জোড় ও বিজোড় সংখ্যার ধারণাও পিথাগোরাস সর্ব প্রথম বের করেন। এমনকি তিনি সংখ্যার লিঙ্গও নির্ধারণ করে দেন; এক পুরুষ এবং দুই নারী। সংখ্যার ব্যবহার পিথাগোরাস এতটা জনপ্রিয় করে তোলেন যে গ্রিকরা এক–কে তাদের দেবতার প্রতিমূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করে দেয়।
পিথাগোরাসের মৃত্যুর ২০০ বছর পর গ্রিসে জন্ম হয় আর্কিমিডিসের। তাকে প্রাচীন যুগের সেরা গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংখ্যা নিয়ে তার এত প্রখর জ্ঞান ছিল যে, তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফল তার ব্যাসার্ধের বর্গ ও পাইয়ের গুণফলের সমান। এ ছাড়া আধুনিক ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসে ব্যবহৃত অতিক্ষুদ্র সংখ্যার ধারণা ও অতি বৃহৎ কোনো সংখ্যাকে ছোট আকারে প্রকাশ করার পদ্ধতিও তিনি বের করেন। ৭৫ বছর বয়সে আর্কিমিডিস এক রোমান সৈন্যের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। আর্কিমিডিসের মৃত্যুর পরও ক্ষমতালোভী রোমানরা বহু শতাব্দী জুড়ে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার একটি বড় অংশ জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটায়।
গ্রিকদের উদ্ভাবিত গাণিতিক পন্থাকে রোমানরা পুরোদমে ব্যবহার করে গাণিতিক সফলতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। রোমানদের ব্যবহৃত রোমান সংখ্যার প্রচলন আজও আছে।
যাই হোক, গণিত বিপ্লবের এত সহস্র বছর পেরিয়ে গেলেও একটি সংখ্যার ব্যবহার মানুষ তখন জানত না, সেটি হলো শূন্য। যদিও প্রাচীন মিসরীয়রা শূন্যকে কেবলমাত্র একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত এবং তারা এটাকে নফর (nfr) নামে ডাকত, যার অর্থ সুন্দর। কিন্তু শূন্য তখনো সংখ্যার মর্যাদা পায়নি। মূলত শূন্য হলো সকল সংখ্যার ভিত্তি ও শূন্যের ব্যবহার ছাড়া বীজ গাণিতিক সমীকরণ লেখা সম্ভব নয়। শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদেরা। তারাই শূন্যকে বাকি বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ভারতীয়রা বহু প্রাচীনকাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সংখ্যা বিদ্যায় বেশ পারদর্শী ছিল। পৃথিবী নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে সূর্যের চারপাশে ঘুর্নায়মান এটা তারা নিকোলাস কোপার্নিকাসের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে তত্ত্ব প্রদান করেন। সর্ব প্রথম পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয় করেন ভারতীয়রা, যেটা এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে আজকের হিসাবের সঙ্গে শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি মিলে যায়। আর এগুলো সবই সম্ভব হয়েছিল সংখ্যার নির্ভুল গণনার মাধ্যমে।
আনুমানিক ৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে একজন ভারতীয় বার্তাবাহকের ইরাকে আগমনের মধ্য দিয়ে আরবের মানুষ শূন্যের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। রাজধানী বাগদাদ ছিল সেসময় মনীষীদের জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। দূর-দুরান্ত এমনকি চীন ও ভারত উপমহাদেশ থেকে প্রচুর ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী বাগদাদে পাড়ি জমান। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আল খোয়ারিজমি, যার জন্মস্থান নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। আল খোয়ারিজমিকে আধুনিক বীজগণিতের জনক বলা হয়। তিনি সর্ব প্রথম গুন ও ভাগ করার জন্য সহজ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন যেটাকে আমরা অ্যালগরিদম বলি। আর সেই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে আজকের কম্পিউটার তার যাবতীয় জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে। এক কথায় আমাদের আজকের আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়া পরিচালিত হচ্ছে অ্যালগরিদমিক ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে।
সেই সময় আরবের বণিকেরা আশপাশের অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রচুর যাতায়াত করতেন। আরবিয় বণিকদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হন তৎকালীন উত্তর আফ্রিকার বণিকেরা। আর তারাও ভারতীয়দের আবিষ্কৃত সংখ্যা পদ্ধতিকে নিজেদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন।
১১০০ সালের শেষের দিকে সালে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়াতে বেড়ে ওঠা এক তরুণ গণিতবিদের প্রচেষ্টায় শূন্যের ব্যবহার ছড়িয়ে পরে ইউরোপে। সেই তরুণের নাম ফিবোনাচ্চি (Fibonacci)। গণিতের জন্য পৃথিবীতে যে কজন পূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ফিবোনাচ্চি জন্মসূত্রে ইতালির নাগরিক হলেও বাবার সঙ্গে ব্যবসার সুবাদে এসেছিলেন আলজেরিয়াতে। তিনি ১২০০ সালে নিজ দেশ ইতালিতে ফিরে প্রকাশ করেন লিবার আবাচি (Liber Abaci), ইংরেজি নাম The Book of Calculation, যেখানে তিনি সর্ব প্রথম আল খোয়ারিজমির উদ্ভাবিত বীজ গাণিতিক ধারণাকে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
এরপর থেকে মানবসভ্যতাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আধুনিক গণিত ও প্রযুক্তি চর্চার মাত্রা ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। সপ্তদশ শতকে গটফ্রিড ভিলহেল্ম নামের একজন জার্মান গণিতবিদ বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যাতে সকল সংখ্যাকে কেবলমাত্র ০ ও ১ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই সংখ্যা পদ্ধতির ভিত্তি দুই। ডিজিটাল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির লজিক গেটে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ রয়েছে। আধুনিক কম্পিউটারে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বাইনারি পদ্ধতিতে প্রতিটি অঙ্ককে বিট বলা হয়। এ রকম ৮টি বিট মিলে গঠিত হয় এক বাইট। ১০০০ বাইটে এক কিলোবাইট। কিলোবাইট থেকে মেগাবাইট, মেগাবাইট থেকে গিগাবাইট ইত্যাদি। আজকের পৃথিবীর প্রতিটি ডিজিটাল যন্ত্রের মেমরিই বিট আকারে জমা থাকে। এভাবেই সংখ্যার জাদুকরী স্পর্শে আমরা পাল্টাতে পেরেছি আমাদের জীবনব্যবস্থা। সুদূর অতীতে কোনো এক আদি পিতামহের ক্ষুদ্র প্রয়াসই আমাদের এই আজকের নবীন সভ্যতার সার্থক জনক। সূত্র- প্রথম আলো।
এশদব্লিউ/এসএস/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ