পঁচিশ বছর আগেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ছিল একটি লাভজনক সংস্থা। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে সংস্থাটি যে টাকা আয় করত, তা দিয়ে ট্রেন পরিচালনার সব ব্যয় মেটানোর পরও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকত। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর সংস্থাটিতে এমন উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, লাভজনক থেকে ক্রমেই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে রেল।
সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে সংস্থাটির লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকায়। লোকসানের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সংস্থাটিকে। সেখানে বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা।
রেলের এ অবস্থার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নিজেদের সম্পদ ও জনবলের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারছে না রেল। প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার পাশাপাশি দুর্নীতিও রেলের ধারাবাহিক লোকসানের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত রেলপথ মন্ত্রণালয়ও। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক উপস্থাপনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রেলের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করা না হলে, রেলের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবং যাত্রীসেবার মান না বাড়ানো হলে লোকসান কমানো কষ্টকর হবে।’
কোনো সংস্থা বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কতটা দক্ষ, তা সহজেই যাচাই করা যায় ‘অপারেটিং রেশিও’র মাধ্যমে। এ অপারেটিং রেশিও মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ে মোট ব্যয়কে মোট আয় দিয়ে ভাগ করে নিরূপণ করা হয়। অপারেটিং রেশিও যত বেশি হবে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা তত দুর্বল হিসেবে গণ্য হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর সংস্থাটির অপারেটিং রেশিও ছিল ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে প্রতি ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হয়েছিল ৯৫ দশমিক ৯ পয়সা। পরবর্তী সময়ে অপারেটিং রেশিওর এ হার আর ধরে রাখতে পারেনি সংস্থাটি।
২০০৮-০৯ অর্থবছর এ রেশিও ছিল ১৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে প্রতি ১ টাকা আয় করতে গিয়ে প্রায় ১ টাকা ৫৯ পয়সা ব্যয় করতে হয় রেলওয়েকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও ছিল ২১৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ রেশিও বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৬ দশমিক ২ শতাংশে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে অপারেটিং রেশিও পৌঁছেছে ২৭৭ দশমিক ৮৩ শতাংশে। অর্থাৎ বর্তমানে প্রতি ১ টাকা আয় করতে গিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের খরচ হচ্ছে প্রায় ২ টাকা ৭৮ পয়সা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় রাজস্ব আয়ের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে দায়ী করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘রেলের কর্মকর্তারা সব সময় বলেন, তারা অর্ধেক জনবল নিয়ে চলছেন। জনবল কম হলে তো বেতন-ভাতা বাবদ পরিচালন ব্যয় কমে আসার কথা। কিন্তু তা তো আমরা দেখছি না। বরং আমরা দেখি কেনাকাটায় রেলের বাড়তি আগ্রহ ও দুর্নীতি। রেলের কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতির কথা আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। এভাবে চললে দিন দিন সংস্থাটির লোকসানের পাল্লা ভারী হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
লোকসান কমিয়ে আয় ও ব্যয়ের অনুপাত সমান করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ এবং বিভিন্ন কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে রেলওয়ের প্রায় ৬০ হাজার একর জমি রয়েছে। এসব জমি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। যাত্রী পরিবহনের ওপর নির্ভরশীলতা পরিহার করতে হবে। মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে।’
রেল যে শুধু আয় অনুপাতে ব্যয় বেশি করছে তা-ই নয়, দেশের পরিবহন ব্যবস্থায়ও রাখতে পারছে না উল্লেখযোগ্য অবদান। গতকাল রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নবিষয়ক এক সভায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট যাত্রীর মাত্র ৪ শতাংশ পরিবহন করছে সংস্থাটি। একইভাবে মোট পণ্যের মাত্র ৪ শতাংশ পরিবহন করছে রেল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের প্রধান খাত যাত্রী পরিবহন। মোট আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। অন্যদিকে সংস্থাটির মোট আয়ের ২০ শতাংশ আসে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে। জমি ইজারা, ক্যাটারিংসহ বিবিধ খাত থেকে আসে অবশিষ্ট আয়। বিপরীতে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত ইঞ্জিন-কোচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ।
মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি হয় এ খাতে। এর বাইরে মোট ব্যয়ের প্রায় ১৭ শতাংশ জ্বালানি তেল খাতে, প্রায় ১২ শতাংশ কর্মীদের বেতন-ভাতা খাতে, প্রায় ৯ শতাংশ প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা খাতে এবং প্রায় ২৯ শতাংশ ব্যয় হয় বিবিধ খাতে।
যদিও গত আড়াই দশকে মোটা অংকের বিনিয়োগ পেয়েছে রেল খাত। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রেল খাতের উন্নয়নে বাড়তি মনোযোগ দেয়। রেলওয়ে বিভাগকে উত্তীর্ণ করা হয় মন্ত্রণালয়ে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয় ৮৩টি উন্নয়ন প্রকল্প।
এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। বর্তমানে চলমান রয়েছে ৩৪টি প্রকল্প, যেগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ১ লাখ ৪১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। যদিও এ বিপুল ব্যয় সংস্থাটিকে লাভজনক করতে পারেনি। উল্টো বছর বছর বড় হয়েছে লোকসানের পরিমাণ। ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২৩’-এর তথ্য বলছে, ২০২০-২১ বছরে সব মিলিয়ে ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি।
বিগত এক যুগে বিপুল বিনিয়োগ আদতে রেলের মানোন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে রেলওয়েতে বড় বড় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের একটা বড় ঘাটতি আছে। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে—তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে রেলের একটা “বাধাধরা”” আয় আসতে পারে। একই রকম আয় আসতে পারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে।
উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া উচিত ছিল এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে। পাশাপাশি গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল ট্রেনের গতি বাড়িয়ে, শিডিউল বিপর্যয় কমিয়ে যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা। কিন্তু এগুলো রেল করতে পারেনি। এখন আমরা কয়েকটা জিনিস দেখতে থাকব। লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে উন্নয়ন ব্যয়ের রিটার্ন। এ ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু রেলকে দায়ী করলে হবে না, পরিকল্পনা কমিশন তথা সরকারেরও যথেষ্ট পরিমাণ দায় আছে।’
তবে রেল দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে—এ কথা মানতে নারাজ রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক যুগ আগের তুলনায় বর্তমানে রেল অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। ট্রেন চলাচলের সময়সূচিতে উন্নতি হয়েছে। আধুনিক ইঞ্জিন-কোচ সংযোজন করা হয়েছে ও হচ্ছে। পুরনো রেলপথ সংস্কার, নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।
যমুনা নদীতে রেলের জন্য পৃথক সেতু তৈরি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করা হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে রেল পরিবহন সেবায় আরো ভালো অবস্থানে পৌঁছে যাবে।’
একই সঙ্গে রেল লোকসানের ধারা থেকেও বেরিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৩০
আপনার মতামত জানানঃ