নিয়ম অনুসরণ না করে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন খাত দেখিয়ে প্রশিক্ষণ ভাতা নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত পদ ছাড়াই ‘বিশেষ বক্তা’, ‘কোর্স পরিচালক’ ও ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসাবে ভাতা নেওয়া, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাতা নেওয়া এবং খাত পরিবর্তন করে এসব টাকা ভাতা হিসাবে নেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া এসব প্রশিক্ষণ ভাতা নিয়ে অডিট আপত্তি উঠলে সেসব টাকা ফেরত দিয়ে এখন নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চাইছেন নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া প্রশিক্ষণ ভাতা নেওয়ায় অডিট আপত্তি এসেছে। নিয়ম অনুসরণ করে এসব ভাতা দেওয়া হলে এমন হতো না। গত সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণ ভাতা নিয়েই এমন ঘটনা ঘটেছে। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। সব প্রক্রিয়ায় মেনে এসব অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে যারা ভাতার নামে এসব অর্থ নিয়েছেন তাদেরকে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, অডিট অধিদপ্তরের আপত্তি করা টাকা ভাতা হিসাবে নিয়েছেন একাধিক নির্বাচন কমিশনার, বর্তমান ও সাবেক সচিব, কয়েকজন যুগ্ম সচিব ও উপসচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ওই সময়ে ‘বিশেষ বক্তা’ হিসাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা বক্তব্য দেন। তবে দুজন কমিশনারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে অডিট বিভাগ। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৎকালীন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক ও কয়েকজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাও বিশেষ বক্তা হিসাবে বক্তব্য দেন। কোর্স পরিচালক হিসাবে কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিআইর তৎকালীন মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক, অঞ্চল পর্যায়ের ইসির আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা পর্যায়ের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা ছিলেন।
এ ছাড়া ইসির সচিবালয়ের যুগ্মসচিব মো. আবুল কাশেম, ফরহাদ আহম্মদ খান, মো. আব্দুল বাতেনসহ কয়েকজন যুগ্মসচিব ও উপসচিবের নেওয়া প্রশিক্ষণ ভাতার ওপরও অডিট আপত্তি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে মোস্তফা ফারুকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে। অতিরিক্ত ভাতা নিয়ে বিতর্ক হলে তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে ফরিদপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসাবে বদলি করা হয়। ইতোমধ্যে এ কর্মকর্তা বেশ কয়েকটি খাতে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা সরকারি ট্রেজারে জমাও দিয়েছেন। তবে রহস্যজনক কারণে এসব বিষয়ে তদন্ত করেনি ইসি।
ইটিআইর সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক কয়েকটি খাতে নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত প্রসঙ্গে বলেন, সবকিছু ভাউচার দিয়ে বিল নিয়েছি। কিন্তু অফিস সেই ভাউচার হারিয়ে ফেললে আমার কী করার আছে। তাই কয়েকটি খাতে টাকা ফেরত দিয়েছি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, নির্বাচন কমিশন যে নিয়ম মানছে সেটা আবারও পরিষ্কার। ইসির সদিচ্ছা থাকলে তারা প্রশিক্ষণের ভাতা নেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করতে পারত। কিন্তু তা না করে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তাকে বদলি কোনো সাজা নয়, তদন্ত করে দায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
জানা গেছে, শুধু ভাতা সংক্রান্ত বিষয়ে সাত কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার ৮০৫ টাকা আপত্তি দিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া প্রশিক্ষণ খাতে ভাতা দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাতা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ১২ হাজার ২৮০ টাকা এবং নিয়মের বাইরে অর্থনৈতিক কোড পরিবর্তন করে ভাতা দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৫ টাকা। এ পরিমাণ টাকা আপত্তির বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেও নিষ্পত্তি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়েকটি খাতের টাকা ফেরত দেওয়ারও কথা জানিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। বাকি টাকার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা সম্মতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রশিক্ষণে অধিকসংখ্যক খাবার কিনে ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং ভুল বিল ভাউচারে ১০ লাখ তিন হাজার ২৫০ টাকা ব্যয় নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিল অডিট অধিদপ্তর। পরে বৈঠক করে ওই অডিট নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে প্রশিক্ষণ ভাতার অডিট নিষ্পত্তি হয়নি। গাড়ি মেরামতে ৬ লাখ ৬৬৬ টাকার ব্যয়ের অডিটও নিষ্পত্তি হয়নি।
আরও জানা গেছে, কমিশন সভায় সব ধরনের অডিট আপত্তির সব ধরনের তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে না। এ সভায় কোর্স উপদেষ্টা পদে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, বিশেষ বক্তা খাতে ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও কোর্স পরিচালক খাতে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ টাকার ভাতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হচ্ছে।
ইসির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের এভাবে অর্থ নেওয়া প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, ইসির ইতিহাসে এমন ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ হয়নি। আমাদের সময়ে সিইসি, আমি ও অন্য কমিশনাররা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণে বক্তৃতা দিয়েছি। কিন্তু কোনো ভাতা নিইনি। এমনকি সচিবও বক্তৃতা দিয়ে ভাতা নিতেন না। সে রকম রেওয়াজও ছিল। এবার যা ঘটেছে সেটা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জন্য অবশ্যই জড়িতদের দায় নিতে হবে।’
জানা যায়, সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য অতীতে ‘বিশেষ বক্তা’ বা ‘কোর্স উপদেষ্টা’ বলে কিছু ছিল না। গত নির্বাচনের সময় এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার জন্য।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, বিভিন্ন খাত সৃষ্টি করে নির্বাচন কমিশনের বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কেবল সংশ্লিষ্ট অর্থ ফেরত দিয়ে ইসি নিজেদের অপরাধকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এসব খাতে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার ব্যাপারে ইসির জ্ঞ্যাতসারেই হয়েছে। এখন অডিট আপত্তি ওঠায় ইসি বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে দোষ কাটাতে টাকা ফেরত দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি কেবল টাকা ফেরত দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডাব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ