বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বেশ কিছুদিন যাবত আমেরিকার সমালোনায় সরব হয়েছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে দৃঢ় কন্ঠে ক্রমাগত আমেরিকার সমালোচনা করছেন, তাতে অনেকে বেশ অবাক হচ্ছেন। প্রকাশ্যে এই সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছিল এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবার সময়।
সর্বশেষ লন্ডনে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি আমেরিকার সমালোচনা করতে পিছপা হননি। আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক সমালোচনা দেশে-বিদেশে অনেকের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং সরাসরি সমালোচনার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল যে দুই দেশের মধ্যে হয়তো কিছু ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, যখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা।
শেখ হাসিনা আমেরিকার সমালোচনায় মুখর হবার আগেও ক্ষমতাসীন দলের কিছু সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল আগেই। পিটার হাস যখন নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল হক সুমনের ঢাকার শাহীনবাগের বাসায় যান তখন ক্ষোভ চেপে রাখেননি আওয়ামী লীগ নেতারা।
ক্ষোভের কারণ কী?
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আর নির্বাচন ঘিরে চাপ; এই দুটা বিষয় মূলত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও নির্বাচন নিয়ে চাপ থাকার বিষয়টি সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের নেতারা কখনোই স্বীকার করেন না।
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ থাকার বিষয়টি প্রতীয়মান হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘হঠাৎ করে আমরা দেখলাম, আমাদের প্রশাসনের ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। কেন? তারা নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।’
“অথচ এই বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিদের, সর্বহারাদের অনেক তৎপরতা ছিল। এই র্যাবকে দিয়েই তাদের দমন করে বাংলাদেশে শান্তি আনা সম্ভব হয়েছে।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, কার স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো? এটা হয়তো পলিটিক্যালি মোটিভেটেড কাজ হতে পারে। সেটা হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই এখানে কোন না কোন ষড়যন্ত্র কাজ করছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিশ্বাস, বিরোধী দলগুলোর তদবির এবং অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে গত দেড় বছরে আমেরিকার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথম দিকে ভাবা হয়েছিল, এটা হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কথাবার্তা বলে সমাধান করা যাবে।
হুমায়ুন কবির, “কিন্তু প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ভালো ধারণা না থাকার কারণে এখন হয়তো তারা একটু হতাশ হয়ে যাচ্ছে। সেই কারণেই তারা অস্বস্তিতে ভুগছে।”
ক্ষোভের আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন ইস্যু। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে আমেরিকা। এর বড় কারণ হচ্ছে, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো সমালোচনা আছে।
গত কয়েকমাসে আমেরিকা এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে আমেরিকার তরফ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়।
এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মধ্যে যখন বৈঠক হয়, সেখানে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়।
ব্লিঙ্কেন সে বৈঠকে বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে আমেরিকা এবং পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে। নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার ক্রমাগত চাপের কারণে ক্ষোভ থাকতে পারে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
হুমায়ুন কবির বলেন, দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্য আছে। এখানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা এই চাপকে ভালো চোখে দেখছেন না। ফলে সেটা তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যেভাবে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে ক্ষোভ বা অভিযোগ জানানো হচ্ছে, সেটা বেশ বিরল বা চোখে পড়ার মতো বলে মনে করছেন এই কূটনৈতিক। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে যে একটা টানাপড়েন তৈরি হয়েছে, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
তবে নির্বাচন ঘিরে সরকারের ওপর বড় কোন চাপ নেই বলে বলছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সরকারের ওপর নির্বাচন নিয়ে চাপ কেন থাকবে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। সেটা করতে আমরা বদ্ধপরিকর, সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে সকল প্রকার সহায়তা করতে প্রস্তুত।’
“আমাদের বিদেশি বন্ধুরাও সেটাই চাইছেন। তাদের এবং আমাদের চাওয়ার মধ্যে তো পার্থক্য নেই। তাহলে তো কোন চাপও তো আসার কথা না। তাহলে সেজন্য কেন ক্ষোভ থাকবে?’’
আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকে মনে করেন যে আমেরিকা ‘নিরপেক্ষ অবস্থানে’ নেই। তাদের ধারণা, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগের পেছনে বাংলাদেশের অনেক ব্যক্তি বা দলের ভূমিকা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেছেন, ‘আপনাকে তো একটা নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে হবে। অন্য রাষ্ট্রের ব্যাপারে নাকগলানো- তাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ কি কোন কথা বলেছে, ট্রাম্প তো এখনো স্বীকার করে না নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। যখন বিদেশিরা এসে নাক গলায়, তখন আমাদের তো খারাপ লাগে।’
বিপদে পড়বে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ছে বেশি, আমদানি বাড়ছে কম। ফলে বাণিজ্য পরিস্থিতি বাংলাদেশে অনুকূলে থাকার প্রবণতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা দেশের মোট আমদানির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৭৪০ কোটি ডলারের পণ্য। এটা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।
মানবজমিন তাদের শিরোনামে বলেছে, আমদানি বন্ধ করলে রপ্তানিও ঝুঁকিতে পড়বে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এতে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, যারা বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনরকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশে। তিনি এই বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছেন বলে জানান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশের প্রভাব তাৎক্ষনিকভাবে না পড়লেও দেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, তাই সেদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ