মহাবিশ্ব কীভাবে শুরু হোল, কবে শুরু হোল, কে শুরু করলো, মহা বিস্ফোরণের (big bang) পূর্বে কী ছিল, বৃহৎ সম্প্রসারণ কীভাবে শুরু হোল, কীভাবেই বা মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে এই সব প্রশ্ন আজকের না। যুগের পর যুগ ধরে মানুষ এই প্রশ্ন করে আসছে। যে কোন একটা ধর্ম গ্রন্থ খুলে দেখুন, দেখবেন এই মহাবিশ্ব কিভাবে এল, কে বানাল, মানুষ কিভাবে এল, মহাবিশ্বের ধংস কিভাবে হবে এই সব বিষয়ে কিছু না কিছু আলোচনা পেয়ে যাবেন। যদিও সে সবই কল্পনা। সেখানে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের কোন জায়গা নেই। অধিকাংশ মন গড়া গল্প। কিছু কিছু আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারনার সাথে মিলে গেলেও তা বিজ্ঞান নয়, সেগুলি নিতান্ত কিছু মন গড়া ধারণা।
আমরা জানি আমাদের visible universe বা দৃশ্যমান মহাবিশ্ব অতীতে এক সময় ছিল খুবই ক্ষুদ্র, অত্যন্ত উত্তপ্ত আর তা নিয়ত সম্প্রসারিত (expanding) হচ্ছে। আমরা আরও জানি যে, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল যখন এই সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে Cosmic microwave background radiation (CMBR) আবিষ্কৃত হয়। এই cosmic microwave background radiation-ই হোল মহাবিশ্বের ইতিহাসের সব থেকে প্রাচীন নিদর্শন যা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। CMBR জিনিসটা কি? মহাবিশ্বের সৃষ্টির একদম আদিতে ঘন উত্তপ্ত মহাবিশ্বের অবশিষ্ট দীপ্তি, যাকে remnant afterglow বলা হয়। মহাবিশ্বের বয়স যখন প্রায় চার লক্ষ বছর, মহাবিশ্ব তখন কেমন দেখতে ছিল CMBR থেকে তার ধারণা পাওয়া যায়। মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স তো আমরা জানিই। চার লক্ষ বছর তার প্রায় 0.003 শতাংশ সময়। এর আগেও কি ছিল, সে বিষয়ে আমরা কি জানি কিছু?
এই CMBR মহাবিশ্বের সব থেকে প্রাচীন রূপ যা আমরা আক্ষরিক অর্থেই প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু তারও অনেক অনেক আগে এই মহাবিশ্বের স্বরূপ কি ছিল, বা তার প্রকৃতি কি ছিল, সেই সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। Cosmic Microwave Background Radiation এর মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের যে সময় আমরা প্রত্যক্ষ করি, সেই সময় মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রায় 2700 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু আমরা জানি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে এবং শীতল হয়েছে। এর অর্থ এই যে আমরা যে সময়কাল প্রত্যক্ষ করছি তার পূর্বে মহাবিশ্ব অবশ্যই অধিকতর উষ্ণ ছিল।
যদিও সেই অপেক্ষাকৃত অধিকতর উষ্ণ মহাবিশ্ব সরাসরি প্রত্যক্ষ করি না, কিন্তু সেই সময়ের মহাবিশ্বের অবস্থা কৃত্রিম উপায়ে Large Hadron Collider এর মতন particle accelerator এ পুনরুজ্জীবিত করে, প্রায় প্রতিনিয়তই সেই পরীক্ষা করতে পারি। এই Large Hardon Collider-এ যখন প্রচণ্ড গতিতে ধাবিত সীসার নিউক্লিয়াসের সাথে অপর কণার সংঘর্ষ হয়, তখন বিপুল পরিমান শক্তি নির্গত হয়, যার ফলে তাপমাত্রা প্রায় সাত ট্রিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই বিপুল পরিমাণ তাপমাত্রায় মহাবিশ্ব পৌঁছে গেছিল যখন মহাবিশ্বের বয়স মাত্র 10-13 সেকেন্ড।
অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত আমরা পরীক্ষা লব্ধ তথ্য পাচ্ছি। যে মুহূর্তে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হোল ঠিক সেই মুহূর্তকে আমরা যদি T=0 সময় বলে ধরে নিই, তাহলে আমাদের কাছে T=10-13 second সময় পর্যন্ত পরিকশালব্ধ ফলাফল আছে। কিন্তু তার আগের মুহূর্তে? ঠিক কথা। T=0 আর T=T=10-13 second সময়ের মাঝেও তো বেশ কিছু সময় আছে। সত্যি কথা বলতে আমরা সথিক জানি না এই সময়ে কি হয়েছিল। ‘সঠিক’ বলতে এখানে নিশ্চিত তথ্যের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের কাছে এই মুহূর্তে পরীক্ষালব্ধ কোন ফলাফল নেই। আমরা জানি না T=0 মুহূর্তে বা তার আগে কি ঘটেছিল, বা কিভাবে ঘটেছিল, বা কেনই বা ঘটেছিল।
আমরা সমস্ত কিছু জানি না ঠিকই, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের কাছে কিছু অনুমান আছে। বিজ্ঞানীরা কিছু প্রকল্প প্রস্তাব করছেন। যার কিছু পরীক্ষা করা যায় বা testable, আর কিছু প্রকল্প পরীক্ষা করার মতন সামর্থ্য আমাদের কাছে নেই, আর কিছু প্রকল্প আছে যা আমরা এখন জানি না কিভাবে তা পরীক্ষা করা যায়। আমাদের কাছে কিছু অনুমান আছে ঠিকই, কিন্তু তা মোটেই কোন গল্প গাথা নয়, বা random বা এলোমেলো কোন চিন্তা নয়। এই অনুমান তথ্য সমৃদ্ধ অনুমান।
তাদের মধ্যে একটি হোল cosmic inflation তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করছে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও মহাবিশ্বের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের বয়স যখন 10-36 second তখন মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে শুরু করে আলোর থেকেও অধিক বেগ নিয়ে। যার কারণে মহাবিশ্বের বক্রতা ও অসামঞ্জস্যতা বিনষ্ট হয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন এই সম্প্রসারণের কারণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। নিশ্চিত বললাম কারণ, আমরা এই অনুমান সঠিক কিনা তা এখন পরীক্ষা করে দেখতে পারি না। কিন্তু আমদের এই অনুমান কোন এলোমেলো চিন্তা না, এই অনুমান তথ্য ও পর্যবেক্ষণ নির্ভর অনুমান।
আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বে বল বা force চার প্রকার, যথা: তড়িৎ-চৌম্বকীয়, মহাকর্ষ, শক্তিশালী ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই বল বা force সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারণা আছে। আর তাদের সম্পর্কে যে টুকু তথ্য আছে তা থেকে মনে হয়, মহাবিশ্বের একদম আদি পর্যায়ে এই বল গুলি একাকার হয়ে ছিল। এদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। এখন ‘মনে হয়’ কথা বললাম এই কারণেই যে আমরা এত উচ্চ তাপমাত্রা এখন কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে পারি নি। কিন্তু গানিতিক তথ্য এই ধারণার দিকেই ইঙ্গিত করে।
তাহলে এই চারটি বল এক সময়ে এক ছিল, আর এখন আমরা দেখছি তারা আলাদা, তার অর্থ এই যে কোন একটা মুহূর্তে তারা আলাদা হয়েছে। ধারণা করা যায় যে, মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হবার সাথে সাথে strong nuclear force অন্যান্য force-এর থেকে আলাদা হয়ে যায়। আর এই phase transition এর ঘটনাই মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করে। এই আনুমান কোন এলোমেলো চিন্তা নয়। আমরা বর্তমানে মহাবিশ্বের স্বরূপ ও ভত বিজ্ঞান যতটুকু জানি তা দিয়েই এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়।
কিন্তু T=10-36 second এর আগে কি হোল? আমরা এটুকু বুঝতে পারি 10-36 থেকে 10-43 second পর্যন্ত মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত ও ঠাণ্ডা হইয়। কিন্তু 10-43 second এর আগে মহাবিশ্ব এতই উষ্ণ ও সংকুচিত ছিল যে সেখানে আমাদের জানা ভৌত বিজ্ঞানের নিয়ম ভেঙ্গে পড়ে। আমরা জানি না এই সময় ভৌত বিজ্ঞান তথা মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে। আগেই বলেছি, 10-36 second সময় থেকে strong nuclear force আলাদা হয়ে যায়, যা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু করে। মহাবিশ্ব পমানুর থেকেও ক্ষুদ্র আকার থেকে বৃদ্ধি পেতে পেতে একটি ছোট লেবুর মতন আকার ধারন করে। এই বৃহৎ সম্প্রসারণের সময়কাল 10-32 second পর্যন্ত।
এর পর মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হতে থাকে 10-13 second পর্যন্ত। এর পরবর্তী সময় থেকে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়য় আপন গতিতে। এই 10-13 second সময়কালের পরবর্তী পর্যায়ের অমস্ত তথ্য আমাদের কাছে আছে।
এখন প্রশ্ন T=0 সময়ে কি ছিল। আগেয় বলেছি T=10-43 second সময়ের পূর্বে আদতেই কি ছিল আমরা ধারনাও করতে পারি না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ভৌত বিজ্ঞানের নতুন দুয়ার না উন্মুক্ত হচ্ছে। যেটা আমরা জানি না সেটা আমরা জানি না। আর তা স্বীকার করতে কোন বাধা নেই। কিন্তু যদি আমরা কোন কিছু না জেনে, সেই অজানা রহস্যের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিতান্ত তথ্য প্রমাণ বিহীন এলোমেলো অনুমান করে বসি, সমস্যা সেখানেই। আমরা বিভ্রান্ত হই অযথা।
এখন কথা হোল আমাদের কি বিন্দুমাত্র ধারণা নেই? উত্তর হোল আছে। কিছু ধারণা ও অনুমান আছে, যার কিছু আমরা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করতে পারি বা বর্তমানে না পারলেও ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতে পারি। এই অনুমানও কিন্তু তথ্য ও জ্ঞান নির্ভর। এলোমেলো অনুমান কখনই নয়।
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব কার্যতই নিতান্ত ক্ষুদ্র ছিল একটি সময়ে। কিন্তু এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে কি ছিল? সেই অদৃশ্য মহাবিশ্ব, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের ধারণা মতন, কিছু না হলেও পাঁচশ গুন বড়। কিন্তু এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরের অবশিষ্ট মহাবিশ্ব এমন ভাবেই অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে যে, মহাবিশ্বের কোন বক্রতা নেই। আবার এই মহাবিশ্ব এমনও হতে পারে যেখানে বক্রতা থাকলেও তা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। এই তথ্য আমারা সঠিক ভাবে কোনদিন জানতে পারব কিনা জানি না।
তাহলে যেটুকু জানি সেটা হোল দৃশ্যমান মহাবিশ্ব খুবই ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও তা শুন্য নয়, কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র। সেই সময় মহাবিশ্ব কেমন ছিল আমরা বলতে পারি না। এমন হতে পারে যেখানে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বের মতন পদার্থের সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়ে চলেছিল। এখানে হয়ত একটা ধারণা আছে যে এই মহা বিস্ফোরণ স্থান ও কালের জন্ম দিয়েছিল। এক্তহা সত্যি যে মহা বিস্ফোরণ (Big Bang) স্থান ও কালকে সম্প্রসারিত করে। কিন্তু T=10-43second এর আগে general theory of relativity কোন নিয়ম আর প্রযোজ্য থাকে না। তাই আমরা জানি না এই সময়ের আগে বা T=0 সময়ের আগে স্থান ও কাল সত্যিই ছিল কি ছিল না।
তাহলে তার আগে কি ছিল? ওই যে বললাম আমরা জানি সঠিক। কিন্তু তথ্য নির্ভর অনুমান করতে পারি। একটা ধারণা এরকম যে মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় বিরাজ করছিল। পরবর্তীকালে তা সম্প্রসারিত হয়। আবার এও হতে পারে এই সময়ের পূর্বে আরও স্থান ও কাল ছাড়াও অন্যান্য মাত্রা ছিল। অর্থাৎ সেই সময় যে মহাবিশ্বগুলি ছিল তা উচ্চ মাত্রা বা higher dimension সন্নিবিষ্ট। সেই মাত্রা বা dimension গুলির সাথে আমরা পরিচিত না বা তাদের মধ্যে আমরা বিচরন করতে পারি না। সেই সময় আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল সেই higher dimension মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে। অতঃপর অন্য কোন মহাবিশ্বের সাথে সংঘর্ষের ফলে উতপন্ন শক্তির দ্বারা আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
আর একটি খুবই প্রচলিত ধারণা হোল, eternal inflation বা চির সম্প্রসারণ তত্ত্ব। মহাবিশ্ব তরলের বিন্দু বা blob-এর মতন একটি অবস্থা যেখানে একটি মহাবিশ্ব আরেকটি মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে বা একটি মহাবিশ্ব অপর মহাবিশ্বের সাথে সংযুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্ব অপর একটি মহাবিশ্ব থেকে উতপন্ন হয়েছে। আর ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ