বিগত ১০ লাখ বছরের ইতিহাসে হোমো সেপিয়েন্স খুব কম সময়ই অন্য কোনো মানব প্রজাতির সংস্পর্শে এসেছে। হোমো সেপিয়েন্সের ঊষালগ্নে কোনো এক সময় মাত্র ১০ হাজার নিয়ান্ডারথাল মানব টিকে ছিল পৃথিবীর বুকে। তারা সে সময় যে পরিমাণ জায়গাজুড়ে বিরাজ করেছে, আজকের দিনে সেখানে প্রায় ৮ লাখ মানুষ বসবাস করে।
যে সময় থেকে হোমো সেপিয়েন্স একাধিক পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ বেধে বসবাস করা শুরু করে তখনও নিয়ান্ডারথালরা বাস করত ছোট ছোট গোষ্ঠী হিসেবে। তাদের এক গোষ্ঠীকে আরেক গোষ্ঠী বিশ্বাস করতে পারত না। ফলে, অনেক সময় তাদের যৌনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া কঠিন হত।
তবে নিয়ান্ডারথালদের পারিবারিক বন্ধন ছিল খুবই দৃঢ়। তারা নতুন কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে খুবই ভয় পেত। ফলে তারা যদি হোমো সেপিয়েন্সকে ছাড়িয়ে পৃথিবীতে টিকে যেত তবে জনসংখ্যা হতো অনেক কম।
নিয়ান্ডারথালরা হোমো সেপিয়েন্স তথা আজকের আধুনিক মানুষের মতো শহর-নগর-বন্দর তৈরি করছে এমনটা ভাবাও কষ্টকর। কারণ, নিয়ান্ডারথালরা অন্যের প্রতি কম বন্ধু মনোভাবাপন্ন।
হোমো সেপিয়েন্সের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ সম্ভবত ১ লাখ বছর আগের নাটকীয়ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টির ওপর নির্ভরশীল। জীনগত বৈশিষ্ট্য এবং শরীরের অন্যান্য উপাদানের আণবিক গঠনই হোমো সেপিয়েন্সকে অন্যান্য মানব প্রজাতি যেমন নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ করে তুলেছে।
তবে তার বাইরে গিয়েও হোমো সেপিয়েন্স প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণিদের অভিযোজন ক্ষমতা থেকে আরও সহনশীল, চাপ সহ্য করার ক্ষমতার রপ্ত করেছে। যেমন, বন্য গুরুদের তুলনায় গৃহপালিত গরুগুলো তুলনামূলক কম জায়গায় বসবাস করতে শিখে যায় বাধ্য হয়ে। এই ধারণার অনুকরণে হোমো সেপিয়েন্স অন্যান্য প্রজাতির মানুষের প্রতি তুলনামূলক সহানুভূতিশীল হতে শিখেছে।
হোমো সেপিয়েন্সের নিজ প্রজাতির অন্যান্যদের সংস্পর্শে আসার প্রবণতা বেশি থাকায় তারা অনেক বেশি জীনগত বৈচিত্র তৈরি করতে পেরেছে। এ কারণে মানুষের রোগ থেকে বেঁচে থাকার সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপরীতে এ ক্ষেত্রে নিয়ান্ডারথালরা ছিল অনেক রক্ষণশীল।
যেমন স্পেনের এল্ সিদরনে পাওয়া নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে থাকা নিয়ান্ডারথালরা তাদের ১৩ প্রজন্মে মাত্র ১৭টি জীনগত বৈচিত্র দেখিয়েছে। হোমো সেপিয়েন্সের এমন প্রবণতা অনেক বেশি। তবে আমাদের প্রজাতির পরিপূর্ণ বিকাশের পর নতুন প্রজন্মে এ ধরনের জীনগত বিবর্তন প্রায় অনুপস্থিত।
হোমো সেপিয়েন্সের ব্যাপক বিস্তার নতুন হুমকিও সামনে এনেছে। যেমন, অধিক মানুষ মানে অধিকহারে রোগ-বালাইয়ের বিস্তার। যার উদাহরণ আমরা দেখেছি বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া বিগত কয়েক শতকের মহামারিতে। নিয়ান্ডারথালরা তুলনামূলক স্বল্পায়ু হলেও তারা যেহেতু নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতো তাই তাদের বিভিন্ন মহামারি থেকে টিকে থাকার সম্ভাবনাও আধুনিক মানুষের চেয়ে বাড়ত।
হোমো সেপিয়েন্সের শিশু জন্মদান হার মানুষের অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। এর মানে হলো, যত বেশি মানুষ তত বেশি খাবার। খাবার না থাকলে মানুষও থাকবে না। মানুষের
জীনে বন্ধুসুলভ মনোভাব জন্ম নিতে শুরু করে ২ লাখ বছর আগে। তখন থেকেই মানুষের আশপাশের সহজলভ্য সম্পদগুলো স্থানান্তরিত হওয়া শুরু করে ব্যাপকহারে।
১ লাখ বছর আগে থেকে মানুষ সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি শুরু করে। তৈরি করতে শুরু করে শিকারের নতুন নতুন অস্ত্র, গয়না ইত্যাদি। শুরু হয় মত বিনিময়, ধর্মীয়-সামাজিক বিভিন্ন প্রথা পালন। এর মধ্য দিয়ে মানুষ খাবারের সংকটের সময় অন্য কোনো এলাকার মানুষের কাছ থেকে খাবার সহায়তা হিসেবে পেতে শুরু করে।
নিয়ান্ডারথালরা টিকে থাকলে সম্ভবত হোমো সেপিয়েন্সকে খাবারের জন্য আবেগীয় ও সামাজিক সম্পর্কের বাইরেও অন্য প্রজাতি কিংবা অন্য ধরনের প্রাণির সঙ্গে নতুন ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হতো।
এমনও হতে পারতো যে, মানুষ পশুপাখি পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করার পরিবর্তে অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করত। নিয়ান্ডারথালরা টিকে থাকলে সম্ভবত পরিবেশে আকস্মিক সব শূণ্যতা তৈরি হতো না। যেমন গাছপালা ও পশুপাখির হুট করে কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো সহজে ঘটত না।
মানুষের যে গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে তার মধ্যে সম্পদ এবং আইডিয়া তথা ধারণা-জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া অন্যতম। মানুষ এ কারণেই ভূমি, খাবার, প্রযুক্তি অন্য এলাকার মানুষের সঙ্গে শেয়ার করে টিকে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছে দারুণভাবে।
এ কারণেই পৃথিবীর বুকে যখন কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে তখন অন্য প্রজাতির মানুষের তুলনায় হোমো সেপিয়েন্সে তুলনামূলক সহজভাবে টিকে গেছে। বিপরীতে অন্যান্য মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হোমো সেপিয়েন্স আবহাওয়ার পরিবর্তনশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সঙ্গেও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। এর আংশিক কারণ ছিল, আমাদের প্রজাতি সংকটের সময়ে নিজেদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারত।
সামাজিক যোগাযোগ হোমো সেপিয়েন্সকে নতুন আবিষ্কার শেয়ারের সুযোগ দিয়েছে। যার ফলে কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষের জন্য টিকে থাকা কঠিন হলেও অসম্ভব হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বল্লম এবং সুই আবিষ্কার মানুষকে দারুণ সুবিধা দিয়েছে। যেমন বল্লম শিকারে সুবিধা দিয়েছে, আবার সুই সুযোগ দিয়েছে প্রয়োজনীয় আটসাঁট উষ্ণ কাপড় তৈরির। যা মানুষকে প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
এর বাইরে খাদ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, নেকড়ের মতো প্রাণিকে পোষ মানিয়ে শিকারে ব্যবহার করা, চাকার ব্যবহার ইত্যাদি মানুষকে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। এসব দক্ষতা না থাকার কারণে মানুষের অন্যান্য প্রজাতি স্রেফ নাই হয়ে গেছে।
হোমো সেপিয়েন্স সাধারণত খাদ্যের উৎসের ব্যাপারে খুবই সচেতন। যেমন মানুষ কখনোই ভালুক কিংবা মাছের মতো সব খাবার একসঙ্গে খেয়ে ফেলে না। এবং হোমো সেপিয়েন্স নিজেদের খাদ্যদ্রব্যের জীবন চক্রের ব্যাপারে অন্য যেকোনো প্রাণির চেয়ে বেশি সচেতেন। যেমন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং কানাডার মানুষ এখনো মাছ শিকারে সময় স্যামন মাছের কেবল পুরুষগুলোকেই শিকার করে।
কিছু ক্ষেত্রে মানুষের খাদ্য চক্রের ভেতরে ও বাইরে থাকা প্রাণির জীবনচক্র টের পাওয়া কঠিন ছিল আগে। যেমন বরফ যুগের সময় বিশালাকায় ম্যামথের বিচরণ ছিল বিশাল এলাকাজুড়ে। অথচ, এই প্রাণিগুলো অনেকটাই মানুষের কারণে মানুষের অগোচরেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে মানুষ এসব ম্যামথের বিলুপ্তিতে শোকাহত হয়েছিল। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ফ্রান্সের রাফিনিয়ায় সন্ধান মেলা ম্যামথের দেয়ালচিত্র থেকে। ধারণা করা যেতে পারে, এসব ম্যামথ টিকে থাকলে, যদি হোমো সেপিয়েন্সের উত্থান না ঘটত। কারণ, নিয়ান্ডারথালরা খুব সামান্যই ম্যামথ শিকার করতে পেরেছে।
আমাদের অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির একে অপরের সঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং একত্রে সময় কাটানোর কারণেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে প্রজাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। তবে বিনামূল্যে এই অভ্যাস মানুষের বৈশিষ্ট্য হয়নি।
মানবজাতি যত বেশি প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, সেগুলোর ততোধিক ব্যবহার আমাদের গ্রহের ক্ষতি তত বেশি ক্ষতি করেছে। অতিমাত্রায় চাষের ফলে আমাদের মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অতিমাত্রায় মাছ শিকার সাগরগুলোকে ধ্বংস করছে এবং আমরা এখন যেসব পণ্যের ওপর নির্ভরশীল তা তৈরি করতে গিয়ে আমরা যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি ছাড়ছি তা আবহাওয়াকে চরমভাবাপন্ন করে তুলছে। পৃথিবীকে অত্যধিক শোষণের বিষয়টি অনিবার্য ছিল না, তবে আমাদের প্রজাতিই প্রথম এই ধ্বংসাত্মক কাজটি করেছে, করে যাচ্ছে।
তবে আমরা আশা করতে পারি যে, আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জগতের ধ্বংসের চাক্ষুষ প্রমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করবে। ইতিহাসজুড়ে হোমো সেপিয়েন্স যখনই কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছে তখনই দ্রুত পরিবর্তন করেছে।
এ পরিবর্তন করতেই হবে কারণ, আমাদের হাতে কোনো বিকল্প গ্রহ নেই। কিন্তু যদি আমাদের পরিবর্তে নিয়ান্ডারথালরা বেঁচে থাকত, তাহলে কখনোই হয়তো এই পরিবর্তনগুলোর প্রয়োজনই হতো না।
এসডব্লিউএসডব্লিউএসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ