ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহকৃত ১২ কেজি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের দাম এক লাফে ২৬৬ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি মাসের জন্য প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে কমিশন, যা গত মাসে ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা।
এ অনুযায়ী এলপিজির দাম বেড়েছে গত মাসের তুলনায় ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সঙ্গে গাড়িতে ব্যবহূত অটোগ্যাসের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা ৩০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারির জন্য প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯ টাকা ৭১ পয়সা, যা গত মাসে ছিল ৫৭ টাকা ৪১ পয়সা।
বিইআরসি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ফেব্রুয়ারির জন্য এলপিজি সিলিন্ডার ও গাড়িতে ব্যবহূত অটোগ্যাসের এ নতুন দাম ঘোষণা করে। বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত নতুন মূল্যতালিকা গতকাল সন্ধ্যা থেকে কার্যকর হওয়ার কথা জানানো হয়।
এক মাসের ব্যবধানে এলপিজির দাম সিলিন্ডারে ২৬৬ টাকা বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে গ্রাহকরা বলছেন, এখন দফায় দফায় অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে রান্নার জ্বালানির এ অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে আরে দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। অনেকের জন্য বাড়তি এ ব্যয়ের বোঝা বহন করা কঠিন।
রাজধানীর মিরপুর-১২ এলাকায় এলপিজির গ্রাহক সাবিনা আক্তার। প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির দাম ২৬৬ টাকা বেড়ে যাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, এলপিজির এ মাত্রায় মূল্যবৃদ্ধি আগে কখনো দেখা যায়নি। বাজারে এ দামে গ্যাস পাওয়া যাবে না, এর চেয়ে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে হবে। গ্যাসের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এ নিয়ন্ত্রণের অভাবেই বিক্রেতারা বিইআরসি ঘোষিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে।
যদিও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসে এলপিজির কাঁচামাল বিউটেন ও প্রোপেনের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশের বাজারে এলপিজির দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বিইআরসির হাতে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়লে বিইআরসির মূল্য সমন্বয়ের সময়ে এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। যদিও এসব কাঁচামালের দাম কমলে এর কোনো সুফল পাননি গ্রাহকরা। বিইআরসি ঘোষিত এলপিজির গত এক বছরের (ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩) মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ ১২ মাসে এলপিজির দরবৃদ্ধির ঘটনাই ঘটেছে বেশি। এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি পণ্যটির দাম বেড়েছে সাতবার, কমেছে পাঁচবার।
এ এক বছরের মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৪০ টাকা। চলতি মাসে মূল্য সমন্বয়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৯৮ টাকায়। অর্থাৎ সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ২৫৮ টাকা বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
অন্যদিকে অটো গ্যাসের দাম বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লিটার প্রতি অটোগ্যাসের দাম ছিল ৫৭ টাকা ৮১ পয়সা। সেখান থেকে প্রায় ২১ শতাংশ বেড়ে এখন তা দাঁড়িয়েছে লিটারপ্রতি ৬৯ টাকা ৭১ পয়সায়।
সৌদি আরামকো ঘোষিত বিউটেন ও প্রোপেনের টনপ্রতি গড় মূল্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতি মাসে দেশে এলপিজি ও অটোগ্যাসের মূল্য সমন্বয় করছে বিইআরসি। যদিও অভিযোগ রয়েছে, প্রতি মাসে এলপিজির দাম সমন্বয় করলেও বাজারে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম রাখা হয় কমিশন ঘোষিত মূল্যের চেয়ে বেশি। বাজারে কমিশন ঘোষিত মূল্যের চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দামে এলপিজি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন ভোক্তারা।
তারা বলছেন, কমিশন ঘোষিত মূল্যে বাজারে এলপিজি সিলিন্ডার পাওয়া যাবে কিনা, সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলপিজির কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারছেন না অপারেটররা। আবার আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে এলপিজি মজুদের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
বেসরকারি এলপিজি অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এলপিজির গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। পাইপলাইনের গ্যাসের সংযোগ না থাকায় রাজধানী ও মফস্বল এলাকায় সিলিন্ডারে কেনা গ্যাস ব্যবহার করেন গ্রাহকরা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে চার সদস্যের একটি পরিবারে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার ব্যবহার করা যায় ২৫ দিনের মতো। বেশি ব্যবহার করা হলে ২০ দিনের বেশি সম্ভব নয়। সেই হিসেবে একটি পরিবারে প্রতি মাসে গ্যাসের সিলিন্ডার বাবদ ব্যয় হয় ২ হাজার ২৫০ টাকার মতো।
গাসের দাম এক লাফে ২৬৬ টাকা বাড়ানো অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তারা। এখানে ভোক্তার বিষয়টি বিবেচনা না করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের বিষয়টি দেখেই দাম বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি গ্রাহকদের।
এসডব্লিউএসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ