বলা হয়ে থাকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এক প্রলংকারী গ্রহাণুর আঘাতে প্রায় ৮০ ভাগ ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় তিমি! তবে ডাইনোসর।দিয়ে শুরু করার কারণ বিজ্ঞানী জেরি কয়েন তার ‘Why the Evolution is ট্রুথ’ গ্রন্থে ডায়নোসর ও তিমির বিবর্তনের মধ্যে একপ্রকার সম্পর্ক আছে বলে প্রদর্শন করেন। সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে এক প্রলঙ্কারী গ্রহাণুর আঘাতে ডায়নোসররা ধবংস হয়ে যায় আর ঠিক একই কারণের পরিণতিতে স্থলচর প্রাণীরা ফিরে যায় মহাসমূদ্রে।
জেরি কয়েন বলেন, “সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল যে তিমি ও তাদের সমগোত্রীয় প্রাণীরা যেমন, ডলফিন ও পরপয়েস আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী। তারা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট, সন্তানের জন্ম দেয়, যাদের তারা দুধ পান করায় এবং তাদের ‘ব্লো হোল’ (মাথার উপর নাকের ছিদ্র) -এর চারপাশে চুল আছে।
তিমির ডিএনএ থেকে নেয়া প্রমাণ এবং বর্তমানে নিষ্ক্রিয় এমন কিছু প্রায় নিষ্ক্রিয় বা ভেস্টিজিয়াল অঙ্গ, যেমন, আদি পেলভিস বা শ্রোণিচক্র এবং পেছনের পায়ের উপস্থিতি প্রমাণ করছে তাদের পূর্বপুরুষ অবশ্যই স্থলে বাস করতো। তিমিরা প্রায় নিশ্চিৎভাবে বিবর্তিত হয়েছে এক প্রজাতির আর্টিওডাকটাইল থেকে।
আর্টিওডাকটাইল স্তন্যপায়ীদের একটি গ্রুপ যাদের জোড় সংখ্যক পায়ের আঙ্গুল আছে। যেমন, উট এবং শূকর। জীববিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করেন তিমির পূর্বসূরিদের সাথে সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক আছে এমন জীবিত প্রাণীটি হচ্ছে—হ্যা, আপনি ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন—হিপোপটামাস বা জলহস্তি। সুতরাং হিপো থেকে তিমির সেই পরিবর্তনের দৃশ্যপটটি খুবই অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয় মোটেও।
একই সাথে তিনি বলেন, তিমির কিছু একান্ত বৈশিষ্ট্য আছে যা স্থলবাসী স্বমগোত্রীয়দের থেকে তাদেরকে ভিন্ন করেছে। সেগুলোর মধ্যে আছে যেমন, পেছনের পায়ের অনুপস্থিতি, সামনের পা যার আকৃতি বৈঠা বা প্যাডেলের মত, চ্যাপটা ফ্লুকের মত লেজ, একটি ব্লো হোল (মাথার ঠিক উপরে থাকা নাকের ছিদ্র); খাটো ঘাড়, সাধারণ ‘কোন’ বা মোচাকৃতির দাঁত (স্থলবাসী প্রাণীদের জটিল, কয়েকটি চুড়া বা কাস্প বিশিষ্ট দাঁত [মাল্টিকাসপিড] থেকে যা ব্যতিক্রম), কানের বিশেষ গঠন, পানির নীচে যা তাদের শব্দ শুনতে সাহায্য করে, মেরুদণ্ডের উপরে হাড়ের শক্ত বিশেষ অংশ যা সাতারের জন্য ব্যবহার করা লেজের শক্তিশালী মাংশপেশীগুলো নোঙ্গর করে রাখে।
মধ্যপ্রাচ্যে খুঁজে পাওয়া একগুচ্ছ বিস্ময়কর জীবাশ্ম প্রজাতির কল্যাণে, আমরা স্থলবাসী থেকে জলচর, প্রতিটি পর্যায়ে এইসব বৈশিষ্ট্যগুলোর ক্রমবিবর্তন লক্ষ করতে পেরেছি (শুধুমাত্র হাড়বিহীন লেজ ছাড়া, যেটি জীবাশ্মীভুত হয় না)।
মজার ব্যাপার হলো ষাট মিলিয়ন বছরের জীবাশ্ম রেকর্ডে অজস্র জীবাশ্ম স্তন্যপায়ীর অস্তিত্ব থাকলেও, কোন জীবাশ্ম তিমির অস্তিত্ব নেই। ৩০ মিলিয়ন বছর পূর্বে সর্বপ্রথম জীবাশ্ম তিমিদের দেখা যায়। তার মানে ৩০ মিলিয়ন বছর সময়ের মধ্যেই আমাদেরকে মধ্যবর্তী পর্যায়ের ট্রান্সজিশনাল ফসিলগুলো খুঁজে পাওয়া উচিত। ৪৬ থেকে ৪৫ মিলিয়ন বছরের ব্যাপ্তিতে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেতে শুরু করলেন অন্তবর্তীকালীন কিছু ফসিল।
বিজ্ঞানীরা তাদের পূর্ব অনুমান অনুযায়ী খুঁজে পেয়েছেন ৪৮ মিলিয়ন বছরের পুরানো রেকুন আকৃতির একটি প্রাণী ইন্ডোহিউস। তিমির পূর্বসূরি জলচরদের উদ্ভবের কিছু পরেই ইন্ডোহিউস জীবাশ্মভূত হয়। কিন্তু তবুও এটি কেনো তিমিদের নিকটতর পূর্বসূরীরা হতে পারে সেটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছাকাছি পর্যায়ের ফসিল মনে করা হয়। এটি আংশিক জলচর প্রাণী ছিলো, পূর্ণবয়স্ক অন্যান্য স্থলচর প্রাণীদের তুলনায় এর হাড়ের ঘণত্ব ছিলো বেশি, যে জন্য এটি কর্কের মতো উপরে ভেসে উঠতোনা, এর দাঁত থেকে পাওয়া আইসোটোপ থেকে জানা যায় যে এটি পানি থেকে অক্সিজেন শোষণ করতো।
আর্টিওডাকটাইল ইন্ডোহিউস থেকে বিবর্তিত আধুনিক তিমিদের মধ্যে একটি হলো বালিন তিমি। যার একটি ভেস্টিজিয়াল বা নিষ্ক্রিয় কোমরের হাড়, পেলভিস বা পেছনের পা আছে, অন্যগুলো সব ট্রান্সজিশনাল জীবাশ্ম প্রজাতি। যদিও ইন্ডোহিউস আধুনিক তিমির পূর্বসূরি না কিন্তু তারা তিমিদের নিকটাত্মীয়। আমরা যদি ৫২ মিলিয়ন বছর পূর্বে যাই তবে আমরা আরো একটি ট্রান্সজিশনাল ফর্ম খুঁজে পাই যার নাম পাকিসিটাস যেটি আরো অনেক বেশি তিমি সদৃশ্য। যাদের সাধারণত সরল দাঁত ও তিমিদের মতো কান ছিলো; তবুও এটি সম্পূর্ণ তিমি সদৃশ ছিলোনা।
আপনি যদি টাইম মেশিনে ব্যাবহার করে ৫২ মিলিয়ন বছর অতীতে যান এনং পাকিসিটাসকে দেখেন আপনার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে, এর কোন নিকটাত্মীয় প্রজাতি কোন এক নতুন বিবর্তনীয় অভিযোজনের জন্ম দেবে। এরপর দ্রুত গতিতে আমরা আরো কিছু প্রজাতির দেখা পাই, যারা ক্রমশ স্থল ছেড়ে জলের দিকে ভ্রমণ করতে শুরু করেছে। ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে পাওয়া যায় এক বিষ্ময়কর আদিম তিমির প্রজাতি অ্যামবুলোসিটাস। এ প্রাণীটি বেশিরভাগ সময় পানিতেই থাকতো, তবে ডাঙায় হাঁটার ক্ষেত্রে এর কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিলো অনেকটা সীল মাছের মতো।
এভাবে জীবাশ্ম রেকর্ডের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা, ৪৯ মিলিয়ন বছর অতীতে চলে যায়, খুঁজে পায় রেডোসিটাস। এটি আরো বেশি জলচর ছিলো, এর নাকের ছিদ্র পেছন দিকে সরে গিয়েছিলো, এর মাথার খুলি ছিল আরো লম্বাটে, এছাড়া মেরুদণ্ডের হাড়গুলো থেকে মোটা প্রক্ষেপন ছিল লেজের মাংশ পেশীগুলোকে (যারা সাঁতারে সাহায্য করতো) মজবুত একটা নোঙ্গর দেবার জন্য, রেডোসিটাস অবশ্যই ভালো সাতারু ছিল, কিন্তু ছোট আকারের পেলভিস এবং পা শুকনো ডাঙ্গায় হাঁটা চলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। এই প্রাণীটি অবশ্যই তাদের বেশীর ভাগ সময়ই কাটিয়েছে সমুদ্রে।
জীবাশ্মের টাইম ট্রাভেল করে আমরা এবার চল্লিশ মিলিয়ন বছর অতীতে চলে যাই আমরা খুঁজে পাবো বাসিলোসরাস (Basilosaurus) ও ডরুডন (Dorudon) এর জীবাশ্ম। এদের খাটো ঘাড়, মাথার উপরে ব্লো-হোল বা নাকের ছিদ্রসহ এরা স্পষ্টভাবে পুর্ণাঙ্গ জলচর স্তন্যপায়ী। পানির বাইরে এরা কোনো সময় কাটাতে পারার কথা না, কারণ তাদের কোমরের পেলভিস বা শ্রোণিচক্র এবং পেছনের পা আরো ক্ষুদ্রাকৃতির ছিল (৫০ ফুট দীর্ঘ ডরুডনের পায়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ২ ফুট) এবং যা বাকী কংকাল কাঠামোর সাথে এমনকি সংযুক্তও ছিল না।
স্থলবাসী প্রাণীদের থেকে খুবই নাটকীয় ও বিষ্ময়কর দ্রুততার সাথে সংঘটিত হয়েছিলো তিমির বিবর্তন। শিম্পাঞ্জি থেকে সেপিয়েন্স পৃথক হতে যে সময় লেগেছিল, এ সময় তার থেকে বেশি নয়, এবং জলের সাথে অভিযোজিত হওয়ার জন্য, তাদেরকে নতুন করে কোন বৈশিষ্ট্যও সংযোজিত করতে হয়নি। শুধুমাত্র যা ঘটেছে তা হলো ইতোমধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলোর সামান্য রদবদল। কিন্ত কেনো স্থলবাসী প্রাণীরা আবার সমূদ্র যাত্রা করেছিলো? কীসের অভাব ছিলো তাদের স্থলের পৃথিবীতে? মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বে যারা সমূদ্র থেকে স্থলে উঠে এসেছিলো মহাসমারোহে? কেনো তারা আবার তাদের আদিম মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়েছিল।
কোন বিশেষ প্রাকৃতিক চাপ তাদেরকে ভূপৃষ্ঠের সাথে অভিযোজিত হতে দেয়নি? এর সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীদের কাছে জানা নেই! অথবা তারা সম্পূর্ণ ভাবে তিমির বিবর্তনের প্রকৃত পরিবেশ সম্পর্কে অজ্ঞাত। কিন্তু ধারণা করা যায়, এর একটি কারণ ছিলো ডায়নোসরদের বিলুপ্তি। বিশেষ করে তাদের ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক সদস্যরা, মাছভোজী মোসাসর, ইকথাইওসর এবং প্লেসিওসর এ সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এদের সাথে জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শুধু খাদ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিলোনা, তারা এদেরকে নিজেদের খাদ্যও বানাতো, তিমির পূর্বসূরিরা হয়তো এদের বিলুপ্তির পর সম্পূর্ণ সমূদ্রকে একা পেয়েছিলো, যেখানে কেউ নেই, শূনতা ছাড়া, আর তারা সে শূন্যতার মাঝে নিজেদের স্থায়ী ভাবে সম্প্রসারণ করেছিলো।
এসডব্লিউএসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ