সংখ্যালঘুবান্ধব আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় আছে। দেশে বরাবরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এখন মূলত রাজনৈতিক অস্থির অবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা।
বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বাড়ছে৷ সম্প্রতি হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সমালোচনা করে পোস্ট দেয়ার জেরে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দু পল্লীতে হামলা চালানোর ঘটনায় আবারও তা সামনে এসেছে৷ সংখ্যালঘুদের ওপর অতীতের সব হামলার মতো এই হামলারও বিচার না হওয়ার আশঙ্কা জাগাচ্ছে সমাজের বাদবাকিদের অধিকাংশের সাবধানী প্রতিবাদ কিংবা সুকৌশলে ঘটনাকে হালকা করে দেয়ার চেষ্টা৷
এরই ধারাবাহিকতায় দেশে গত এক বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৫৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৩৯ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২৭ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে। শুক্রবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
পরিসংখ্যান যা বলছে
প্রতিবেদনটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও সংগঠনটির কর্মীদের দেয়া তথ্য অনুসারে তৈরি করা হয়েছে বলে জানান এই জোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮৯ হাজার ৯৯০ একর জমি দখল করা হয়েছে। বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭২টি পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৪৪৫টি পরিবারকে। গত বছর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মোট ২২০ কোটি ৮৯ লাখ টাকার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, গত এক বছরে দেশের হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৫৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে ৮৪৯ জনকে, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৪২৪ জনকে এবং জখম ও আহত করা হয়েছে ৩৬০ জনকে। নিখোঁজ রয়েছেন ৬২ জন। চাঁদাবাজি হয়েছে ২৭ কোটি ৪৬ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় পরিবার ও মন্দির লুট হয়েছে ৩১৯টি। বসতবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৮৯১টি, অগ্নিসংযোগ হয়েছে ৫১৯টি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে ১৭৩টি। ঘরবাড়ি দখল হয়েছে ৫৭টি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ৫০টি এবং মন্দিরের ভূমি দখল হয়েছে ৫১টি। দখলের তৎপরতা ৯৮৪ একর ১২ শতাংশ। বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭২টি পরিবারকে। উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে ৩ হাজার ৬৯৪টি পরিবারকে এবং উচ্ছেদের হুমকি দেয়া হয়েছে ৩৫ হাজার ৮১৮টি পরিবারকে।
দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৪৪৫টি পরিবারকে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশত্যাগে হুমকির শিকার ১৫ হাজার ১১৫টি পরিবার এবং নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯১টি পরিবার। সংঘবদ্ধ হামলা ৯৫৩টি। মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১২৮টি, প্রতিমা ভাঙচুর ৪৮১টি, প্রতিমা চুরি ৭২টি। অপহরণ করা হয়েছে ১২৭ জনকে এবং অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৭ জনকে। ৩৯ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৭ জন। ধর্ষণের পর ১৪ জন হত্যার শিকার হয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ৫৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৫২ জনকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করা হয়েছে ৪০ জনকে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ভিন্নমত দমন ও সহনশীলতা চর্চার অভাবে দেশে অসহিষ্ণু ও বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি।
মিথ্যা মামলায় আসামি গ্রেপ্তার, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুত করা এবং জেল-জরিমানার শিকার হয়েছেন ৭৯১ জন। ১ হাজার ৬৫৭টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণের ঘটনা ঘটেছে ১৭৯টি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়ার ঘটনা ১২৯টি। ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাইয়ে ৩৩৩ জনকে অপবিত্রকরণসহ একটি পরিবারের ওপর গোমাংস নিক্ষেপ করা হয়েছে।
মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করেনি।
এ সময় বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধকল্পে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং একটি উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখার দাবি জানানো হয়।
মামলার হার কম
এদিকে নির্যাতন হলেও মামলার হার অনেক কম। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা কাজল দেবনাথ বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
“নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়েরের হার ক্রমশ কমছে। এসব মামলায় বিচার পাওয়ার হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ। নির্যাতনের ঘটনায় বিচার আমলে না নেওয়া, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও যথাযথ বিচার না পাওয়ায় অনেকেই মামলা করেন না।”
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “এই ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগও মামলা করে না। কারণ মামলা করলে তো আরেক ধরনের নির্যাতন। আসামিরা হুমকি দেবে, দেশছাড়া করবে। আইনের বিরাট পরিবর্তন দরকার। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে, সেই সঙ্গে তারা যেন গুরুত্ব দিয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা করে সেটাও দেখতে হবে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গ্রেপ্তারেরও সমালোচনা করেন কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, “ধর্মীয় অবমামনা আইনটি যদি সব ধর্মের জন্য হয়, তবে এর সুফল মানুষ পাবে। চারটি ধর্মের যে কোনো জায়গায় যে কোনো আচড় লাগলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একইভাবে রিঅ্যাক্ট করতে হবে।”
এসডব্লিউএসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ