১৯৭৪ সালে একটি ফসিল সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করতে করতে খুঁজে পেলেন ৩২ লক্ষ বছর আগের অল্পবয়েসি এই নারীর ফসিল, মাত্র সাড়ে তিন ফুট লম্বা! এই আদি মানুষটির সাথে শিম্পাঞ্জির অনেক মিল থাকলেও, মানুষের মতোই দু’পেয়ে গড়ন তার। কিন্তু ছোট্ট এই ফসিলটা কেন এত হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল? একটু বুঝিয়ে বলি।
আজকে সারা পৃথিবীতে যত রকমের মানুষ দেখতে পান, তাদের সবাই একই হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা কিন্তু সবসময়ই একমাত্র মানব প্রজাতি ছিলাম না। ওই ফসিল আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি প্রাচীন মানব প্রজাতির কথা জানতাম আমরা। ভাবা হতো, মানব বিবর্তনের শুরুতে, অন্যান্য এপ বা নরবানরদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, আদি মানব প্রজাতিদের মধ্যে প্রথমে মস্তিষ্কের আকার বড় হতে শুরু করেছিল এবং তারও অনেক পরে আমরা দ্বিপদী হয়ে উঠতে শুরু করি।
কিন্তু এই ফসিলটি সেই ধারণাগুলো ভেঙে চুরমার করে দিল। এর পরে, গত কয়েক দশকে, ২০টিরও বেশি প্রজাতির মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জেনেটিক্স এবং জিনোমিক্সের অত্যাধুনিক গোয়েন্দাগিরি গবেষণা, আর এসব কিছু থেকে আমরা আমাদের নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি চাঞ্চল্যকর সব তথ্য!
শুধু ফসিল রেকর্ড থেকেই নয়, আণবিক জীববিদ্যা, আধুনিক জেনেটিক্স-জিনোমিক্সের ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে আমরা দেখছি ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বছর আগে গরিলা, বনোবো, শিম্পাঞ্জি এবং আমাদের পূর্বসূরিরা এক ছিল। মোটামুটি সে-সময়েই গরিলার পূর্বসূরিরা আলাদা হয়ে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। তারপর আমাদের, মানুষের, লিনিয়েজ থেকে ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগে বনোবো ও শিম্পাঞ্জিদের পূর্বসূরিরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে এখানে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার করে বলে নেওয়া দরকার一না, আমরা মানুষেরা সরাসরি শিম্পাঞ্জি থেকে আসিনি, বরং শিম্পাঞ্জি, বনোবো এবং মানুষ একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে বিবর্তিত হয়েছে। শিম্পাঞ্জিরা আমাদের পূর্বপুরুষ নয়, বরং বলা যায় তারা নরবানরদের পরিবারের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের বংশগতীয় পার্থক্য ২%-এরও কম।
শিম্পাঞ্জিদের পূর্বসূরিদের সাথে আলাদা হয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই, ৭০ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু করে ৪৪ লক্ষ বছর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আদিম মানুষের প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে। এদের ফসিল রেকর্ড থেকে বোঝা যায়, আফ্রিকা মহাদেশে, সেই মায়োসিন যুগে, দীর্ঘ সময় ধরে, ধীরে ধীরে, শিম্পাঞ্জি এবং আমাদের পূর্বসূরিদের মধ্যে ঘটেছে বিচ্ছেদ এবং একই সাথে সংকরায়ন বা ক্রস-ব্রিডিং-এর ঘটনা।
আর সেখান থেকেই শুরু আমাদের বিবর্তনের জটিল এবং দীর্ঘ এই গল্প। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো মানুষের প্রজাতি Sahelanthropus tchadensis-এর অসম্পূর্ণ ফসিল থেকে দেখা যাচ্ছে এদের মস্তিষ্কের আকার শিম্পাঞ্জির মতো ছোটো, কিন্তু চেহারার গঠন আবার অনেকটা মানুষের মতো! তাদের শ্বদন্ত ছোটো এবং তারা দুপায়ের উপর ভর করে হাঁটতেও পারছে। কীভাবে বোঝা গেল তারা দুই পায়ে হাঁটতে পারতো? কারণ এদের foramen magnum, বা খুলির তলার যে-ফুটোটা দিয়ে মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ুরজ্জু বেরিয়ে মেরুদণ্ডে যায় সেটা অন্যান্য নরবানরদের তুলনায় অনেকটা সামনের দিকে一ঠিক মানুষের মতোই। এই পরিবর্তনটা না-ঘটলে শরীরকে খাড়া রেখে দুই পায়ের উপর ভর করে দাঁড়ানো সম্ভব হতো না মানুষের।
এ যুগের আরেকটু পরের অন্যান্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য Ardipithecus ramidus বা আর্ডি। ২০০৯ সালে আর্ডির ফসিলের আবিষ্কার হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল, কারণ তখনই প্রথম আমরা কোনো আদি-মানুষ প্রজাতির ফসিল খুঁজে পাই যার শ্রোণী, মাথার খুলি, হাত পা এবং আঙুলের হাড়ের গঠন থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে সে একদিকে যেমন গাছে চড়ে বেড়াতে পারতো, তেমনি আবার তারা আমাদের চেয়ে কম দক্ষভাবে হলেও দুই পায়ের উপর ভর করে হাঁটতেও সক্ষম ছিল।
মূলত দু’পায়ে হাঁটা এবং আঙুলের ব্যবহার—এই দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বিশ্বের অন্য সমস্ত প্রাণীদের থেকে আলাদা করে দেয় মানুষকে। তবে মানুষের পূর্বপুরুষরাও একদিন বানরের মতোই বসবাস করত গাছে। বৃক্ষবাসী প্রাণী হয়েও কীভাবে মানুষ দু’পায়ে দাঁড়াতে শিখল, একাধিক তত্ত্ব রয়েছে তা নিয়ে।
পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্য রহস্য মানুষের এই বিবর্তনবাদ। কিন্তু এত কিছুর পরেও যদি বলা হয়, হাঁটার জন্য দু’পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি মানুষ? এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সায়েন্স অ্যাডভান্স বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণা জানাচ্ছে এমনটাই।
পূর্ব আফ্রিকান রিফট ভ্যালি থেকে তানজানিয়ার ইসা উপত্যকায় বসবাসকারী শিম্পাঞ্জিদেরই মানুষের নিকটতম আত্মীয় বলে ধরে নেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি এই অঞ্চল থেকেই বিবর্তিত হয়েছিল মানুষের পূর্বপুরুষরা।
কাজেই মানুষের ইতিহাস জানতে এই আফ্রিকান এপদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করেই, এই আশ্চর্য দাবি করছেন তাঁরা।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, ইসা শিম্পাঞ্জিরা সাধারণত বসবাস করে সাভানা-মোসাইক অঞ্চলে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে স্বল্পসংখ্যক গাছ থাকার কারণে বেশিরভাগ সময় মাটিতেই কাটাতে হয় তাদের। তবে তা সত্ত্বেও রাত কাটানোর জন্য গাছের আশ্রয় নেয় এই ধরনের এপ।
আজ থেকে ৫০ লক্ষ বছর আগে মায়োসিন-প্লিওসিন যুগে হোমিনিনরাও এই একইধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল বলেই অনুমান গবেষকদের। সে-সময় শুধু বৃক্ষনির্ভর জীবনযাপন নয়, বরং সমতল সাভানা তৃণভূমিতেও ঘুরে বেড়াত তারা। প্রাথমিকভাবে এই হাঁটাহাঁটি চলত চার পায়েই।
তবে তৃণভূমি ছেড়ে গাছে ওঠার সময় ব্যবহার করত দ্বিপদ। গবেষকদের অনুমান এই ঘটনাই ক্রমশ দ্বিপদবাদের বিবর্তনের জন্ম দিয়েছিল। বা, বলা চলে আবাসস্থল পরিবর্তনই ছিল মানুষের এই বিবর্তনের অনুঘটক। দু’পায়ে হাঁটা কখনই মূল উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের পূর্বপুরুষদের। কারণ, দু’পায়ে হাঁটলে দেহের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
অবশ্য এখনও অমীমাংসিত থেকে গেছে বহু প্রশ্ন। এইসকল রহস্যের উত্তর পেতে আফ্রিকান ইসা শিম্পাঞ্জিদের আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউএসএস/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ