জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি। এরই মধ্যে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা। সহিংসতায় ঘটছে প্রাণহানিও। রাজপথে জানান দিতে নিয়মিত সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে আসছে বড় দুই দল। দলগুলোর মাঠের কর্মসূচি ঘিরে বাড়ছে হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা। নেতাদের বক্তব্য নিয়ে চলছে কাদা ছুড়াছুড়ি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন কেউ কেউ। এদিকে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আর বাড়ছে পুলিশী দমন পীড়ন- যেন আওয়ামী লীগের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে পুলিশ।
এরই ধারাবাহিকতায় ফরিদপুরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ বুধবার বিকেলে ফরিদপুর শহরের মুজিব সড়কসংলগ্ন প্রেসক্লাব চত্বরে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণ ও চেয়ার ভাঙচুর করায় ওই সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। এ ঘটনায় দুই এসআইসহ পুলিশের পাঁচ সদস্য ও বিএনপির আট নেতা–কর্মী আহত হন।
ফরিদপুর জেলা বিএনপির নেতারা বলেন, পুলিশের সামনে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন। এতে তাদের আট নেতা–কর্মী আহত হয়েছেন।
তবে পুলিশ বলছে, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীরা নন, বিরোধের জেরে বিএনপির একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর হামলা চালিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শটগানের গুলি ছোড়া হয়।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ জলিল বলেন, এই হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খায়রুল বাসার ও জাকির হোসেন এবং কনস্টেবল জোবায়েরসহ পুলিশের ৫ সদস্য আহত হয়েছেন। তারা পুলিশ হাসপাতাল প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া বলেন, হামলায় তাদের অন্তত আট নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। ঘটনার সময় পুলিশ রিতু, কামাল, রাজীব, সিজানসহ বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনপির সমাবেশে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ইশতিয়াক বলেন, ‘বিএনপি নিজেরা নিজেরা মারামারি করে দায় আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। সব জায়গাতেই সব সময় তারা এই কাজটি করে।
তবে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ওই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাউসার আকন্দ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউসার আকন্দ বলেন, ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। তবে যাঁরা হামলা করেছেন, তারা হেলমেট পরিহিত ছিল। তাদের তিনি চেনেন না। এ হামলায় তিনি নেতৃত্ব দেননি। তবে তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে ওই স্থান থেকে চলে আসেন।
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে যথাক্রমে বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আবদুল মঈন খান ও বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ায় তারা আর বক্তব্য দিতে পারেননি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, সমাবেশ উপলক্ষে ফরিদপুর প্রেসক্লাব চত্বরে ছোট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা তখনো ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাননি। ওই সময় মঞ্চে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ও সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়াসহ কয়েকজন নেতা ছিলেন। এ সময় বক্তব্য দেন জেলা ছাত্রদল সম্পাদক ইমরুল হাসান কায়েশ, মহানগর কৃষক দলের আহ্বায়ক মামুনুর রশিদ।
এরপর বেলা ৩টা ৫৪ মিনিটের দিকে জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুর রহমান বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে হেলমেট ও মাস্ক পরা ৩০ থেকে ৩৫ জন তরুণ লাঠি ও ইট নিয়ে হামলা চালান। হামলাকারীরা ব্যানার ছিনিয়ে নেন, চেয়ার ভাঙচুর করেন এবং তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ১১টি ফাঁকা গুলি ছুড়ে হামলাকারীদের হটিয়ে দেয়। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম আবদুল কাইউম বক্তব্য দেন। এরপর বিএনপির নেতারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বিকেল সোয়া চারটার দিকে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেন, আফজল হোসেন খান, খন্দকার ফজলুল হক, মহানগর যুবদলের সভাপতি বেনজির আহমেদ কিছু সমর্থক নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। ওই সময় পুলিশ সিজান নামের ছাত্রদলের এক কর্মীকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে। এ ঘটনায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে পুলিশের ধ্বস্তাধস্তি হয়।
বিএনপির প্রতিবাদ
বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটের দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আবদুল মঈন খান ও বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ঘটনাস্থলে আসেন। বিএনপির সমাবেশ হামলা চালানোর ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মঈন খান বলেন, ‘এখানে আজ আমাদের যে সমাবেশ ছিল, সেটা ছিল সাধারণ মানুষ ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে। এসবের প্রতিবাদে একটি শান্তিপূর্ণ ছোট সমাবেশ করতে এসে আমরা হামলার শিকার হলাম।’
শামা ওবায়েদ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত বিএনপির ১১ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে গত চার দিন আগে আমরা এ বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছি। পুলিশের তত্ত্বাবধানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ এ হামলা করেছে। তারা পুলিশের সামনে গুলি করেছে, ককটেল ফাটিয়েছে। এতে আমাদের অনেক নেতা–কর্মী আহত হয়েছেন। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
শামা ওবায়েদ আরও বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখেছি, তারা বিভিন্ন জায়গায় ককটেল রেখে গায়েবি মামলা দিচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ তারা ফরিদপুরে প্রেসক্লাবে ককটেল ফাটিয়ে আমাদের লোকদের ধরপাকড় করেছে। আপনারা দেখেছেন, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে কেমন সফল সমাবেশ হয়েছে। এ সমাবেশ দেখার পরে আমরা মনে করি, ফরিদপুরে যারা সরকারি লোকজন আছে, প্রশাসন আছে, তারা ভয় পেয়ে গেছে। তারা আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় যে গণসমাবেশ হবে, তা নস্যাৎ করার জন্য এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।’
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া বলেন, হামলায় দিলীপসহ তাদের অন্তত আট নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। ঘটনার সময় পুলিশ রিতু, কামাল, রাজীব, সিজানসহ বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ জলিল বলেন, ফরিদপুর বিএনপিতে দুটি পক্ষ আছে। এর মধ্যে এক পক্ষের নেতৃত্ব শামা ওবায়েদ ও অপর পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নায়াব ইউসুফ। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ থেকে সভাস্থলে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশ ১১টি শটগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এসডব্লিউএসএস/২১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ