কয়েকটি ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হলেও কোনো কোনো ঘটনা তদন্তের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে বহু ধর্ষণ মামলা চলে আসছে। তথ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাসও পেয়ে যাচ্ছে অথবা এজাহার থেকে অনেকের নামও বাদ দেয়া হচ্ছে।
সিটি কলেজের ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরাকে ২০০০ সালের ১ জুলাই রাতে পশ্চিম হাজিপাড়ার বাসায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ মামলায় ২০০৩ সালের ৩০ জুন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রায়ে এমএ কাদের, শওকত ও কবিরের মৃত্যুদণ্ড এবং রুনু কাদেরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। বুশরার আত্মীয় এমএ কাদের ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রুনু কাদেরের দণ্ড বহাল থাকলেও আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সব আসামিই খালাস পান।
অপরদিকে ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে গুলশানে নিজ বাড়িতে শাজনীন তাসনিম রহমান খুন হন। ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার দায়ে ছয় আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেন।
হাইকোর্টের রায়ে পাঁচ আসামি হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়। ২০১৬ সালের ২ আগস্ট গৃহভৃত্য শহীদুল ইসলামের (শহীদ) মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। খালাস পান বাড়ির সংস্কারকাজের দায়িত্ব পালনকারী ঠিকাদার সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসান ও তার সহকারী বাদল, বাড়ির গৃহপরিচারিকা দুই বোন এস্তেমা খাতুন (মিনু) ও পারভীন। হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৮ বছর পর চূড়ান্ত রায় আসে। এ দুই মামলায় আসামি পক্ষে আইনজীবী ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিশিষ্ট ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন। সর্বোচ্চ আদালত কোন গ্রাউন্ডে দুই মামলায় আসামিদের খালাস দিলেন জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বুশরা হত্যা মামলায় প্রকৃত অপরাধীকে আসামি হিসেবে আনা হয়নি।তাহলে কারা এ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আউট সাইট থেকে কেউ ঘটনাটি ঘটিয়েছিল বলে আমরা মনে করছি। আর শাজনীন হত্যা মামলার আসামি গৃহভৃত্য শহীদুল ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অন্যরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাদের এ মামলায় জড়ানো হয়েছিল। তাই তারা খালাস পেয়েছেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও বলেন, সঠিক তদন্তের অভাবে অনেক সময় প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যায়। এসব মামলা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, যেসব ধর্ষণ মামলা প্রকাশ পায় সেগুলোর সংখ্যা খুবই কম। এর চেয়েও বেশি সংখ্যক ঘটনা প্রকাশ পায় না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ মামলা বেড়ে যাওয়ার কারণ অপরাধীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শক্তি ও সমর্থন। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ায় তারা মনে করে আমাদের সাজা হবে না। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন প্রভাবিতও হন। এ কারণে অনেক সময় সঠিক তদন্ত হয় না। তাড়াহুড়া করে চার্জশিট দেয়ায় মূল আসামি বাদ পড়ে যায়। এরপর সাক্ষ্য-প্রমাণের যথেষ্ট অভাব থাকে। সাক্ষ্য দিতে অনেকে সাহস পায় না। এজন্য আমাদের নির্ভর করতে হবে সঠিক ডিএনএ ও মেডিকেল টেস্টের ওপর।
এগুলো দিয়ে আসামিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
ধর্ষণের ঘটনা তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ধর্ষণের মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে সঠিকভাবে তদন্তকাজ শেষ করতে হবে। যথাসময়ে তদন্তকাজ করার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে তা আদালতে সঠিকভাবে উপস্থাপন এবং সাক্ষ্যগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, কোনো রকম মুলতবি না রেখে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলার বিচার নিয়ে হাইকোর্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কখনও দেখা যায়নি। হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষিত রয়েছে।
২০১৯ সালের ২১ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন হাইকোর্ট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা পৃথক তিনটি মামলায় আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ আদেশ দেন। অভিমতে আদালত বলেন, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আদালত এটিও প্রত্যাশা করেন যে সরকার অতি অল্প সময়ে ওই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।
বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। পুলিশের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে- গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি।
পুলিশের হিসাবে, গত বছর ধর্ষণের পর ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যান। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১ নারী ও ১৪ শিশু। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।
আপনার মতামত জানানঃ