বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিপুল ভর্তুকি সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসের হিসাব অনুযায়ী, এ দু’টি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগেই ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও নিত্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা জনগণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগেই দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়নো হতে পারে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগেই যা বাস্তবায়ন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ‘পিরিয়ডিক্যাল এডজাস্টমেন্ট’ (মেয়াদি বা অস্থায়ী সমন্বয়) করার শর্তও বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্দিষ্ট সময় পর পর এই সমন্বয় করতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম পিরিয়ডিক্যাল এডজাস্টমেন্ট করতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। সরকার এ শর্ত আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন করবে’।
বুধবার আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার-ও গ্যাসে ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে সংস্থাটির শর্ত দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আইএমএফ সার ও গ্যাসের ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা করেছে। আমরা তাদের বুঝিয়েছি যে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সারে ভর্তুকি দিতে হবে’।
এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিপুল ভর্তুকি সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসের হিসাব অনুযায়ী, এ দু’টি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগেই ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও– নিত্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা জনগণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে– তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
কিন্তু, এবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা ছাড়া সরকারের কোনো বিকল্প নেই। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সার, গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্যে ভর্তুকি এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনায় বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে সারসহ কৃষিখাতে ভর্তুকির পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি; বিদ্যুৎখাতে ১৮ হাজার কোটি এবং এলএনজি’তে ১৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বরাদ্দের তুলনায় ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এছাড়া, ভর্তুকি কমাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আইএমএফ-এর শর্তের কথাও প্রধানমন্ত্রীকে জানানা তারা। ওই সভা শেষে একজন সিনিয়র সচিব টিবিএসকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
তবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লেও এ দু’টি খাতে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে না বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা আরও বলেছেন, দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কতোটা সমন্বয় করা হবে– সে বিষয়ে চলতি মাসে বৈঠক ডেকেছে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, “গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম এমনভাবে বাড়ানো হতে পারে, যাতে এ দু’টি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দকে অতিক্রম না করে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রতি ১৫ দিন পর পর আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করে। উন্নত দেশগুলো সকাল-বিকাল মূল্য সমন্বয় করে। বাংলাদেশ কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করবে, সে বিষয়ে একটি ফর্মুলা সরকারকে দিয়েছে আইএমএফ।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএ-এর শর্ত মেনে চলতি মাসেই আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজারের চাহিদা ও সরবরাহ অনুসারে, ব্যাংকগুলিকে ডলার কেনাবেচার পরামর্শ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ভিত্তিতেই বাজারভিত্তিক আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে শুরুতে ডলারের দর কিছুটা বাড়ার আশঙ্কা থাকলেও– ডলার কেনা ও বেচার মূল্য ব্যবধান এখনকার তুলনায় অনেক কমে আসবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে সার, জ্বালানি তেলসহ সরকারের আমদানি ব্যয় মেটাতে ৯৭ টাকা দরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার প্রতিষ্ঠার পর এই দরও বাজার দরের সঙ্গে যৌক্তিকীকরণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া, বছরে দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জানুয়ারি মাসে চলতি অর্থবছরের জন্য দ্বিতীয় মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতি প্রান্তিকের তথ্য প্রকাশ করার সক্ষমতা অর্জন করলে– তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রতি প্রান্তিকের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ