ডারউইনের বিবর্তনবাদ পৃথিবীর ইতিহাসে এক অমোঘ পথনির্দেশ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’-এর নামকরণে উপশিরোনাম হিসাবেই লেখা হয়েছে মূল কথাটি। তিনি প্রজাতির উদ্ভবের অন্তরালে রেখেছেন এক অসামান্য তত্ত্ব, ‘বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন অর দ্য প্রিজারভেশন অফ ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ’। একইসঙ্গে তিনি সংযুক্ত করেছেন ‘অভিযোজনবাদ’-এর ধারণাকে যা প্রাকৃতিক নির্বাচন ও জীবনে টিকে থাকার সংঘর্ষের আয়ুধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর কোটি-কোটি প্রজাতির মধ্যে মানুষও একজন। ফলে সামগ্রিক চৈতন্য থেকে সে একেবারে আলাদা হয়ে যেতে পারে না। অন্যান্য শ্রেণির প্রাণী অর্থাৎ অন্যান্য স্তন্যপায়ী, পাখি, পতঙ্গ, মাছ প্রভৃতি প্রাণীদের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ চরিত্র কী প্রকারের তা বিচার করলেই ‘ধর্ষণ’ সম্পর্কে জানা যাবে, বোঝা যাবে জীবনে টিকে থাকার সংঘর্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনে ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনে’ আর মানুষের ধর্ষণ কতটা ভিন্ন।
প্রথমে ধরা যাক, আর্থোপোডা শ্রেণিভুক্ত প্রাণী ওয়াটার স্ট্রাইডারের কথা। এদের মধ্যে যৌনমিলনের জন্য স্ত্রীলিঙ্গের প্রতি বল প্রয়োগ করতে দেখা যায়। পুংলিঙ্গ পতঙ্গটি স্ত্রীলিঙ্গ পতঙ্গটিকে জোর করে আটকে রেখে জলের মধ্যে পদচালনার মাধ্যমে তরঙ্গ সৃষ্টি করতে থাকে, যাতে মাছের মত প্রাণীরা আকৃষ্ট হয়। ফলত স্ত্রীলিঙ্গের কাছে থেকে যায় দুটি উপায় – এক, মাছের খাদ্য হওয়া; দুই, পুংলিঙ্গের কাছে আত্মসমর্পন করা। স্ত্রীলিঙ্গের কাছে নির্বাচন স্পষ্ট, সে বেঁচে থাকতেই পছন্দ করবে।
এছাড়াও বহু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে, যেমন – ছারপোকা, মাকড়সা ইত্যাদি, ট্রমাটিক ইনসেমিনেশনের ঘটনা দেখা যায়। ট্রমাটিক ইনসেমিনেশন হল শরীরে ক্ষত করে শুক্রাণুর প্রবেশ ঘটানো। এর লাভ দুটো; এক, যেহেতু অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে মুক্ত-সংবহনতন্ত্র বর্তমান, ফলে শরীরে যেভাবেই শুক্রাণু প্রবেশ করুক তা সঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়; দুই, শরীরের ক্ষত দেখে অন্যান্য পুরুষ প্রাণীরা আকৃষ্টও হয় না আর।
অন্যদিকে পাখিদের মধ্যেও ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ দৃষ্টান্ত কম নেই। একধরণের দলবদ্ধভাবে থাকা মাছরাঙাদের মধ্যে দেখা যায় যে, স্ত্রী-পাখি যদি একা কোথাও যায় তবে অন্য পুরুষ পাখিরা আক্রমণ করে। কিংবা ম্যালার্ড হাঁসের ক্ষেত্রে দম্পতি হাঁসের স্ত্রীটি গর্ভবতী হলে পুরুষদলের আক্রমণ দেখা যায় অন্য সঙ্গীহীন বা দুর্বল সঙ্গীযুক্ত স্ত্রী-হাঁসের ওপরে।
ভোঁদড়ের ক্ষেত্রেও একইরকম অত্যাচারের ঘটনা দেখা যায়। আবার মানুষের সঙ্গে একই বর্গভুক্ত প্রাণী ওরাংওটাং বা শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনের’ ঘটনাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। ডলফিনের মধ্যেও এই ধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং, মানুষের মধ্যেও ‘জোরপূর্বক যৌনমিলনের’ প্রবৃত্তি থাকা প্রাকৃতিকভাবে অসম্ভব কিছু নয় (আবারও বলছি, ‘প্রবৃত্তি’। এখানে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করা হয়নি।)
নারীশরীর ও পুরুষশরীরের মধ্যে আছে বিশেষ পার্থক্য। অনেক মানসিক পার্থক্যও আছে। এই ফারাককে তিনটে প্রেক্ষিতে বিচার করা সম্ভব – এক, যৌন নির্বাচন; দুই, জীবনসত্তার সংঘর্ষ ও তিন, যৌন চাহিদার স্তর। ফলে পুরুষের সঙ্গে নারীর যে পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল,
১। পুরুষরা নারীদের থেকে আকৃতিতে বড়সড় হয়।
২। নারীদের থেকে পুরুষদের জন্মহার বেশি হয়।
৩। পুরুষদের জীবনকাল নারীদের থেকে কম হয় (আন্ডার ফাইভ মর্টালিটি নারীদের বেশি হলেও প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মর্টালিটিতে নারীরা বেশিদিন বাঁচে ও নারীদের শারীরিক ত্রুটি অনেক কম হয়)।
৪। পুরুষরা অনেক বেশি হিংসাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে।
৫। নারীদের থেকে পুরুষরা বেশি আক্রমণাত্মক হয়।
৬। পুরুষদের যৌনসঙ্গী নির্বাচনে বাছবিচার নারীদের তুলনায় অনেকাংশে কম হয়।
৭। পুরুষদের মধ্যে স্বমেহনের পরিমাণ নারীর থেকে বেশি।
এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা হিসাবে বলা যায় যে, যেহেতু একজন পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদনক্ষমতা (সেকেন্ডে প্রায় ১৫০০টি করে প্রায় ৬০ বছর বয়স অব্দি) নারীদের ডিম্বাণু উৎপাদনের (২৮দিনে একটি করে প্রায় ৪৫ বছর বয়স অব্দি) চেয়ে অনেক অনেক বেশি তাই পুরুষ যতটা বহুনারীসঙ্গের প্রতি উৎসাহী হয় নারীরা ততটা বহুপুরুষগামীতা দেখায় না। কেননা জিনের ধর্মই হচ্ছে নিজেকে যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব রেপ্লিকেট করা। আবার একজন পুরুষের সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রযুক্ত বল ও সময় (১৫মিনিট মতন) নিতান্তই মামুলি এবং সেখানে উপভোগ ছাড়া প্রায় আর কিছুই থাকে না।
পক্ষান্তরে নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের ঝুঁকি অনেক তীব্র ও সময়সাপেক্ষ (৯মাস প্রায়)। এরপরে থেকে যায় সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব ও পরবর্তী সন্তান জন্ম দেওয়ার শারীরিক প্রস্তুতি। ফলে পুরুষ প্রাকৃতিকভাবে যেখানে লাভ করে বাছবিচারহীন বহুগামীতার উত্তরাধিকার, সেখানে নারীর থাকে একজন যোগ্য পুরুষকে নির্বাচনের আকাঙ্খা যে তাকে সামাজিক সুরক্ষা দেবে ও তার প্রতি সৎ থেকে সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন করবে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেখানে পুরুষকে বাছবিচারহীন ও নারীকে নির্বাচনপ্রবণ বলছে
তাই যেখানে নারী কর্তৃক পুরুষ বাধাপ্রাপ্ত হয় সেখানেই পুরুষের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ পথ বেছে নেয়ার প্রবৃত্তি কাজ করে। তবে প্রকৃতি এর মান্যতা দেয় না। এই না দেওয়ার কারণে আসছি কিছুটা পরে। আগে আরও একটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক।
আবার ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ফলে যেসব প্রাণীর ক্ষেত্রে অস্তিত্ব সংকটের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে সেখানে আবার প্রকৃতিই নারীকে দিয়েছে বিশেষ প্রতিহত ক্ষমতা। যেমন, ম্যালার্ড হাঁসের ক্ষেত্রে অভিযোজনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ‘কর্ক-স্ক্রু’ যৌনতন্ত্র কিংবা অলীক গহ্বর যা ওভারিতে পৌঁছয় না। ডাঁশমাছির ক্ষেত্রে আছে ৮০টির মত গ্ল্যান্ড প্রোটিন যা তার জীবনকাল কমিয়ে দেয় বা যৌন উত্তেজনাকে হ্রাস করে দেয়। মৌমাছি বা কাঠবেড়ালিতে দেখা যায় মেটিং প্লাগ যা সেমিনাল ফ্লুইডের দ্বারা যৌনদ্বার বেশ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়।
তবে মানুষের মধ্যে এইরকম কিছু দেখা যায় না। তাই মনে হতে পারে মানুষের মধ্যে বিবর্তবাদ অনুযায়ী অভিযোজনগতভাবেই ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ঘটনাকে মান্যতা দেওয়া হয়। তবে এখানেই প্রশ্নবোধকের কাছে উত্তর হিসেবে আসে সামাজিকতা। যা মূলত মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে।
যদি ধরে নেওয়া যায় যে পুরুষরা যেহেতু কম দিন বাঁচে ফলে সে বেশি সন্তান উৎপাদন করে যেতে চায় তার জীবনকালে, সেক্ষেত্রেও ‘জোরপূর্বক যৌনসম্ভোগের’ ফলে সন্তান জন্মের সম্ভবনা নিতান্তই ক্ষীণ। তাছাড়া যদি সন্তানসম্ভবা হয়ও নারীটি সেই সন্তানের বেঁচে থাকার প্রশ্নটিও উপেক্ষা করা যায় না। অন্যদিকে মানুষের টিকে থাকার জন্য ‘জোরপূর্বক যৌনমিলন’ বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া নয়। নারীটির যদি যৌনরোগ থাকে বা আক্রমণাত্মক হয় তাহলেও পুরুষের পক্ষে সুস্থ জীবনকাল কমে যাওয়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। ফলে পুরুষের পক্ষে এই অভিযোজনে ঝুঁকি অনেক বেশি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ