অবিভক্ত বঙ্গের ইতিহাসে মীর আশরাফ আলী ছিলেন সবচাইতে ধনী জমিদার। তিনি যতটুকু বিখ্যাত তার ধনসম্পদের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি কুখ্যাত নিজের অত্যাচারী চরিত্রের জন্য।
মীর আশরাফ আলী জন্মেছিলেন ইরানের শিরাজে। তার বাবার নাম ছিলো মীর আলী মাহদী। তার জন্মনাম মীর আলী আশরাফ হলেও আমরা সবাই তাকে চিনি মীর আশরাফ আলী নামে। মীর আশরাফ আলী ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইরান থেকে ভারতবর্ষের এলাহাবাদে (সম্প্রতি নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ) আসেন। তারপর তিনি জীবিকার তাগিদে বঙ্গে পাড়ি জমান। বঙ্গে এসে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মদদপুষ্ট ঢাকার নায়েব নবাব নুসরাত জং ও তার পরে নবাব শামসুদ্দৌলার সভাসদে বেশ কয়েকবছর চাকরী করেন।
মীর আশরাফ আলী বেতনের জমানো অর্থ দিয়ে জমিদারি কিনতে শুরু করেন। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকা, ত্রিপুরা (কুমিল্লা), বাকেরগঞ্জ (বরিশাল), ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় তার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।
সে সময় তার জমিদারির আয়তন ছিলো তিন লক্ষ বিঘা। জমিদারি থেকে তার বার্ষিক আয় হতো অন্তত ২,৫০,০০০ টাকা। ত্রিপুরার বলদাখাদ তথা বর্তমান কুমিল্লা জেলার নবীনগর উপজেলায় ছিলো তার জমিদারি এস্টেট। সেসময় তিনি থাকতেন অধুনা কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে।
তবে ঢাকা শহরের রেসকোর্স ময়দানের দিকে ফুলবাড়িয়াতে বর্তমান ফজলুল হক হলের জমিতে ছিলো তার রাজকীয় প্রাসাদ। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তার ছিলো অগাধ আনুগত্য। ত্রিপুরা যুদ্ধে মীর আশরাফ আলী ব্রিটিশদের অর্থ প্রদান করা ছাড়াও আরো বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। ব্রিটিশরা সাহায্যের অর্থ পরে ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন।
যেমনটা আগে বলেছিলাম, মীর আশরাফ আলী ইতিহাসে তার সুখ্যাতির জন্য জনপ্রিয় হলেও তার কুখ্যাতির কথা ইতিহাসে লেখা হয়নি, কেন হয়নি তা জানা নেই। তবে ইতিহাসে না থাকলেও মুরাদনগরের অধিবাসীদের মুখে মুখে এখনো আছে তার অত্যাচারের ইতিহাস।
তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে জানা ঘটনাগুলো সময়ের সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পোঁছে গেছে। মুরাদনগর এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় একসময়ের সমৃদ্ধশালী জমিদার মীর আশরাফ আলী এমন কোন খারাপ কাজ নেই যা তিনি করেন নি। তার সম্পর্কে প্রথম যে চমকপ্রদক তথ্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে মীর আশরাফ আলী নরখাদক ছিলেন তথা তিনি মানুষের মাংস খেতেন।
এছাড়া শোনা যায় তিনি ছিলেন চরিত্রহীন এবং নারীলোভী। তিনি মুরাদনগরের মেয়েদের প্রায় জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতেন। এছাড়াও কর আদায়ের নামে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন তো আছেই। মীর আশরাফ আলী নিজের খেয়াল খুশিমতো চলতেন।
লোকমুখে প্রচলিত, একবার মীর আশরাফ আলীর মানুষের কলিজা খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তিনি তার বাবুর্চিকে মানুষের কলিজা রান্না করার আদেশ দেন। বাবুর্চি ভয় পেয়ে যান, কেননা মীর আশরাফ আলী ছিলেন মানুষের মাংসের প্রতি আসক্ত। যে কোন প্রানীর কলিজা মাংসের চেয়ে স্বাভাবিকভাবে বেশি সুস্বাদু হয়। যদি নবাব মানুষের কলিজার স্বাদ পেয়ে যান তবে আরো বেশি বেশি কলিজা খেতে চাইবেন।
একটা মানুষ মারলে তার মাংস অনেকদিন খাওয়া যায় কিন্তু একটা মানুষের দেহে কলিজা অগণিত থাকেনা। সেক্ষেত্রে মীর আশরাফ আলী কলিজা খাওয়ার লোভে বেশি মানুষ হত্যা করবেন। তাই বাবুর্চি বুদ্ধি করে কলিজার সাথে তিতা কিছু মিশিয়ে দেন। মীর আশরাফ আলী সেই কলিজা মুখে নেওয়া মাত্রই থু দিয়ে ফেলে দেন। এরপর আর কখনো তিনি মানুষের কলিজার কথা উল্লেখ করেন নি। তবে মানুষের মাংসের প্রতি লোভ নবাবের ক্রমশ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে জনসাধারণের উপর অত্যাচারের মাত্রা।
তাই মুরাদনগরের লোকজন এক গোপন জায়গায় সভা ডাকে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে রাতে মীর আশরাফ আলীর মঞ্জিলে অতর্কিত হামলা করে নবাব ও নবাবের পরিবারকে হত্যা করা হবে। কিন্তু সেই সভায় আগেই নবাবের এক তোষামোদকারী উপস্থিত ছিলো, সে দ্রুত গিয়ে নবাবকে খবরটা জানায়। নবাব তাকে পুরষ্কৃত করে দ্রুত পরিবার নিয়ে ঢাকার পথে পালিয়ে যান। মীর আশরাফ আলী মৃত্যু পর্যন্ত ঢাকাতেই ছিলেন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে মীর আশরাফ আলী মারা যান। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফার্মেসি বিভাগের সামনে তাকে কবর দেওয়া হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ