উচ্চতা ১.১ মিটার। ওজন প্রায় ৪০ কেজি। এমপেরর পেঙ্গুইন-খ্যাত আন্টার্কটিকার এই বাসিন্দা বিশ্বের বৃহত্তম পেঙ্গুইন প্রজাতি হিসাবেই পরিচিত। সম্প্রতি এন্ডডেনজার্ড স্পিসিস অ্যাক্টের মাধ্যমে ‘বিপন্নপ্রায়’ থেকে বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় জায়গা পেল এই প্রজাতিটি।
বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমশ কোণঠাসা করে তুলছে এমপেরর পেঙ্গুইনদের, এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
দক্ষিণ মেরুর বিভিন্ন অঞ্চলকে পেঙ্গুইনের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল মনে করা হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে এর বসতি। আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কমছে পেঙ্গুইনের সংখ্যাও।
অবাক করার বিষয় হল, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এমপেরর পেঙ্গুইনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে লক্ষের কাছাকাছি। সাধারণত, কোনো বিশেষ প্রজাতির এত বিপুল সংখ্যক প্রাণী পৃথিবীর বুকে জীবিত থাকলে, সেই প্রজাতিটিকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ গোত্রে অন্তর্গত করা হয় না। তবে এমপেরর পেঙ্গুইনের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু অন্যরকম।
এই পেঙ্গুইনরা মূলত প্রজনন করে আন্টার্কটিকায়। কয়েক হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে, মেরু অঞ্চলের বরফের চাদরের ওপরে তৈরি করে কলোনি। বর্তমানে সবমিলিয়ে আন্টার্কটিকায় রয়েছে ৬১টি এমপেরর পেঙ্গুইন কলোনি।
এম্পেরর পেঙ্গুইনের জন্য প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধির জন্য সমুদ্রে স্থিতিশীল বরফ থাকাটা জরুরি। এপ্রিল মাস নাগাদ ৫০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এরা প্রজননক্ষেত্রে আসে। নারী পেঙ্গুইনরা ডিম পেড়ে খাবারের সন্ধানে সমুদ্রে ফিরে যায়।
আর ডিসেম্বর নাগাদ সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়া পর্যন্ত পুরুষ পেঙ্গুইনরা ডিমে তা দেয়। প্রতিটি পেঙ্গুইন মাত্র একটি ডিম পাড়ে। এম্পেরর পেঙ্গুইনদের গড় আয়ু ২০ বছর হলেও কোনো কোনো পেঙ্গুইন ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
ওয়েডেল সাগরের হেলি বে কলোনি এম্পেরর পেঙ্গুইনের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বসতি। হেলি বে কলোনি গত ৬০ বছর ধরে সমুদ্রে বরফ স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। প্রতি বছর এখানে ১৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার পেঙ্গুইন প্রজননক্ষম হতো। বিশ্বের মোট এম্পেরর পেঙ্গুইনের শতকরা ১০ ভাগেরই বসতি ছিল এই হেলি বে কলোনি। ফলে এম্পেরর পেঙ্গুইনদের জন্য এটি বেশ নিরাপদ একটি আশ্রয়স্থল ছিল এতদিন।
কিন্তু গত তিন বছরে এই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, পৃথিবীর উষ্ণায়ন এই হারে বাড়তে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এম্পেরর পেঙ্গুইনের এই রাজত্ব।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। ফলে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে একের পর এক পেঙ্গুইন কলোনি। ম্যাসাচুসেটের উডস হোল ওসিয়ানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের তথ্য জানাচ্ছে, বিগত ৩০ বছরে অন্ততপক্ষে ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে পেঙ্গুইন কলোনির সংখ্যা।
অর্থাৎ, বর্তমানে এমপেরর পেঙ্গুইনদের সংখ্যা স্থিতিশীল হলেও, তাদের প্রজননের হার হ্রাস পাচ্ছে ক্রমশ। ফলে, অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে এই প্রজাতির ভবিষ্যৎ।
তবে শুধু এই বিশেষ প্রজাতিই নয়, এমপেরর পেঙ্গুইন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলে প্রভাবিত হবে আন্টার্কটিকার গোটা বাস্তুতন্ত্র। স্কুইড, ছোটো মাছ এবং ক্রিল শিকার করে জলের জু-প্ল্যাংটন এবং ফাইটো-প্ল্যাংটনের অনুপাত বজায় রাখে এই পেঙ্গুইনরা।
পাশাপাশি তারাই আবার লেপার্ড সীল কিংবা কিলার হোয়েলদের খাদ্য। সবমিলিয়ে এমপেরর পেঙ্গুইনরা অবলুপ্ত হলে, আন্টার্কটিকার জীববৈচিত্রের সমীকরণ যে গোটাটাই পাল্টে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু কীভাবে সংরক্ষণ সম্ভব এই প্রজাতির?
প্রথমত, জলবায়ু সংকট এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনে নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে, এই প্রজাতির অবলুপ্তি নিশ্চিত। গবেষকদের অনুমান, ২১০০ সালের মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে অবলুপ্ত হয়ে যাবে ৯৮ শতাংশ এমপেরর পেঙ্গুইন। ফলে, উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু বদলে রেশ টানাই সংরক্ষণের প্রাথমিক ধাপ বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
তাছাড়াও শুরু হয়েছে বিশেষ গবেষণা। কৃত্রিমভাবে এই পেঙ্গুইনের প্রজননের বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে। সেইসঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আদৌ এমপেরর পেঙ্গুইন বিবর্তিত হচ্ছে কিনা, সে-বিষয়েও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
‘মেয়ার’ প্রকল্পের আওতায় ৩০ জোড়া পেঙ্গুইনের পিঠে সংযুক্ত করা হয়েছে মাইক্রোচিপ। তাদের গতিবিধি, দৈনিক আচরণ এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপার নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
উল্লেখ্য, আজ থেকে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগের কথা। পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এমপেরর পেঙ্গুইনদের পূর্বসুরি কলোসাস পেঙ্গুইনরা। ২ মিটার উচ্চতা এবং ১১৫ কেজি ওজনের এই মাংসাশী পেঙ্গুইনদেরও ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন। এবার কি আরও একবার পুনরাবৃত্ত হতে চলেছে সেই ঘটনা?
এসডব্লিউএসএস/১৩৫৪
আপনার মতামত জানানঃ