বিশ্বে প্রতিদিন যক্ষ্মায় মারা যান ৪ হাজার ১০০ জনের বেশি মানুষ। বিশ্বে যক্ষ্মায় আক্রান্ত মোট রোগীর দুই-তৃতীয়াংশ যে আটটি দেশে আছে, তারই একটি বাংলাদেশ। আবার যক্ষ্মা যে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হয়, তা–ও কিন্তু নয়, সবার মধ্যেই আছে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। বিশেষত শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়ে। রোগ কিংবা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসেও আক্রমণ করতে পারে যক্ষ্মার জীবাণু।
ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, অপুষ্টি, মদ্যপান, মাদক সেবন, ধূমপান—এসব যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভবতী নারী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি, কেমোথেরাপি কিংবা দীর্ঘদিন স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন—এমন ব্যক্তি ও এইচআইভি আক্রান্ত মানুষেরাও রয়েছেন ঝুঁকিতে। ঝুঁকির তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে করোনা। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে অনেকেরই যক্ষ্মার ঝুঁকি বেড়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ মানুষের টিবি শনাক্ত হয়, এর মধ্যে মারা যান ৪০ হাজার মানুষ। অর্থাৎ দেশে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যক্ষ্মায়, দিনের হিসাবে এই সংখ্যা ১১০।
তবে মারা যাওয়ার হার কমেছে। আগে যেখানে ৭০ হাজার ছিল, বর্তমানে সেটি ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। আমাদের মৃত্যু বেশি, কারণ আমাদের জনসংখ্যাও বেশি।
আজ রোববার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ৯ম যৌথ মনিটরিং কর্মশালায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সফলতা তুলে ধরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, যক্ষ্মায় আক্রান্তদের ৯৫ ভাগই চিকিৎসা পাচ্ছে। তাদের জন্য দেশেই ওষুধ তৈরি করছে সরকার।
আগামীতে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে। দেশে ভালো মানের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। টিবিতে (যক্ষ্মা) আমাদের যে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে, প্রয়োজনে তা বাড়ানো হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জাহিদ মালেক বলেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি হয়েছে, শনাক্তকরণ (স্ক্রিনিং) কার্যক্রম বেড়েছে। আমাদের সব হাসপাতালে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি রয়েছে। যক্ষ্মা নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনো ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, তবে পরিবর্তন আসছে, মানুষ চিকিৎসাকেন্দ্রে যাচ্ছে।
বর্তমানে আক্রান্তদের ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছে। আমরা চাই মানুষ চিকিৎসা নিতে আসুক। এর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এগিয়ে আসায় তাদের ধন্যবাদ।
কীভাবে যক্ষ্মা ছড়ায়
যক্ষ্মা বা টিবি একটি বায়ুবাহিত ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগ সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায় এবং দেহে প্রবেশ করে প্রথমে ফুসফুসে আশ্রয় নেয়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত সব রোগীর কাছ থেকেই কিন্তু যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায় না।
যাদের থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাদের হাঁচি-কাশি, এমনকি কথা বলার সময়ও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। এ জীবাণু বেশ কয়েক ঘণ্টা বাতাসে ভেসে থাকে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে বাতাসে ভেসে থাকা এ জীবাণু। এভাবেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ।
অপরিশোধিত দুধ পানের মাধ্যমেও যক্ষ্মার জীবাণু ছড়াতে পারে। ঘনবসতি বা আবদ্ধ স্থানে এ জীবাণু অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হাড়, মস্তিষ্কের আবরণ, কিডনি, অন্ত্র ও প্রজনন অঙ্গকে আক্রমণ করতে পারে।
যক্ষ্মার সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি কাশি, কিছু ক্ষেত্রে কাশির সঙ্গে রক্ত, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস, জ্বর এবং রাতে ঘাম হওয়া।
রোগীর প্রতি অবহেলা নয়
যক্ষ্মা এমন একটি রোগ, যাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরীর। সঠিকভাবে চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা শুরু করা হলে রোগীর কাছ থেকে খুব বেশি দিন যক্ষ্মা ছড়ায় না।
কত দিন পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি জীবাণু ছড়াচ্ছে, তা নির্ণয় করতে নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হয়। তবে যক্ষ্মার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। ওষুধের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে।
নিয়ম মেনে রোজ সকালে খালি পেটে ওষুধ খাওয়া, নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা—সব মিলিয়ে এ চিকিৎসা এক দীর্ঘ যাত্রার শামিল। এ যাত্রার মাঝপথে বিরতি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওষুধ সেবনে অনিয়মিত হলেই বিপদ।
শারীরিক ও মানসিকভাবে যক্ষ্মা রোগীরা অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে থাকে। তাই পরিবার থেকে সব ধরনের সমর্থন তাকে দিতে হবে। রোগীকে মাস্ক পরার গুরুত্ব বোঝাতে হবে, অন্তত যত দিন তার কাছ থেকে জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু কখনোই তাকে অস্পৃশ্য ভাবা যাবে না। নিজেরাও মাস্ক পরে থাকুন। সামাজিকভাবেও রোগী বা তার পরিবারকে একঘরে করে ফেলা যাবে না। রোগটিকে অভিশাপ মনে করা যাবে না। রোগীর সঠিক পুষ্টি ও যত্ন নিশ্চিত করুন।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় প্রায় বিনা মূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসা করা হয়। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদেরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। উপজেলা পর্যায়েও সরকারিভাবে যক্ষ্মার ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
তাই চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই। ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’—এ ধরনের কথা এখন অর্থহীন। সঠিক চিকিৎসায় যক্ষ্মা সেরে যায়।
যক্ষ্মা শুধু বুকে নয়
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র, পাকস্থলি, টনসিল, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি এমনকি মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডও। সব সময় যে শুধু কাশি নিয়ে ধরা পড়বে, তা–ও নয়।
যক্ষ্মা হলে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করা আবশ্যক। মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দিলে ওষুধের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। ওষুধ প্রতিরোধী এমন যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে। তাদের রোগ প্রচলিত যক্ষ্মার ওষুধে সেরে যাওয়ার মতো অবস্থায় আর নেই। একে বলে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স টিবি বা এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স টিবি।
আর সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, এমন রোগীর কাছ থেকে অন্য কারও শরীরেও ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। এ ভয়াবহ সমস্যা এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন যেমন করতে হবে, তেমনি থাকতে হবে নিয়মিত ফলোআপে।
যক্ষ্মা প্রতিরোধে
যক্ষ্মার টিকা রয়েছে, যা সংক্রমণের জটিলতা প্রতিরোধ করতে সক্ষম। জন্মের পর সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায়ই যক্ষ্মার এ টিকা দেওয়া যায়।
সবাইকেই হাঁচি-কাশির আদবকেতা মানতে হবে। যেখানে সেখানে কফ-থুতু ফেলা যাবে না। ব্যবহৃত টিস্যু, রুমাল বা মাস্ক যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না। ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়।
মনে রাখবেন, আপনার সিগারেটের ধোঁয়া আপনার এবং অন্যদেরও ফুসফুসের ক্ষতি করছে। যেকোনো নেশাজাতীয় দ্রব্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
যাদের যক্ষ্মার ঝুঁকি রয়েছে, বিরাট কোনো জনসমাগমস্থলে তাদের না যাওয়াই ভালো। যক্ষ্মা রোগীদের সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে অন্যদের মধ্যে ছড়ানোর ঝুঁকি কমে।
যক্ষ্মার চিকিৎসা
প্রধানত চারটি ওষুধ দিয়ে যক্ষ্মার চিকিৎসা করা হয়। ফুসফুস অথবা শরীরের কোন অংশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত, তার ওপর নির্ভর করে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত চিকিৎসা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে চিকিৎসা সাফল্য প্রায় শতভাগ। কিন্তু কখনো কখনো টিবি ভালো হয়ে আবার আক্রমণ করতে পারে কিংবা চরম ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটাতে পারে।
এসডব্লিউএসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ