‘এতো দাম’ বলায় একবার এক দোকানদার আমাকে বলেছিলেন, মানুষ বাদে আর সবকিছুর দাম বাড়ে। আর সেটাই সত্য হচ্ছে। চাল-আটাসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের চিনির বাজার। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। যা স্মরণকালের সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দাম বেড়েছে প্রায় সবকিছুর। বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়ও। ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। মৌলিক অধিকার পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষ।
আর তাই একটা প্রশ্ন জাগে, যেটা হলো- কোনও সরকারের পক্ষে কি আরও বেশি ব্যর্থ হওয়া যায়!
সপ্তাহখানেক আগে ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ে মাহমুদা আক্তার বৃষ্টির ছয় বছরের ছেলে জুনায়েদের। ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে প্রথমে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা দিতে থাকেন। এতে তার খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা।
কিন্তু জুনায়েদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটে (বিএসএইচআই) ভর্তি করা হয়। সেখানে মাত্র দুদিনেই তার চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা।
মাহমুদা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। তার স্বামী শফিকুল পেশায় দারোয়ান। দুজনের মিলিত মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা। এমনিতেই বাসা ভাড়া দেওয়ার পর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, এর মধ্যে ছেলের চিকিৎসা ও যাতায়াতে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এভাবে আরও কতদিন জুনায়েদের চিকিৎসা চালাতে হবে, তারা জানেন না।
চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গু প্যারাসিটামল ছাড়া তেমন কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। সঙ্গে বেশি বেশি তরল খাবার দিতে হবে। ডেঙ্গুতে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জরুরি। ডেঙ্গু রোগীদেরে প্লাটিলেট মাত্রা জানতে প্রতিদিনই রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। তাই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও রক্ত পরীক্ষা ও তরল খাবারে গড়ে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়।
তবে এ বছর ডেঙ্গু রোগীরা ভাইরাসের একাধিক ভেরিয়েন্টের কারণে দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাড়িতে রেখে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি হওয়ায় অনেক ডেঙ্গু রোগী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা সরকারি হাসপাতালে চিকৎসা নিলেও ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যয় দুই থেকে তিন গুণ গুণ বেশি। এখানে বেড ভাড়াসহ সব খরচ তুলনামূলক বেশি। আর ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট দেয়া বা আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।
আড়াই বছরের নিলীমা চৌধুরীর ডেঙ্গু চিকিৎসায় শিশু হাসপাতালে ৯ দিনে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান নিলীমার বাবা রণি চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩০০ টাকার সিবিসি টেস্ট, ৭০০ টাকা বেড ভাড়া ও ৫০০-৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। একদিন ২৫০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ আহমেদুল কবির জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বারের মতো আক্রান্ত হওয়ার কারণে এ বছর সিভিয়ারিটি অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “এছাড়া ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত তিন দিন পর কমে যায়, তারপর হঠা” ৫ দিনের দিন রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। জ্বর কমে গেলে বা না থাকলে রোগী ভেবে নেয় সুস্থ্য হয়ে গেছে। তখন ঠিকমত লিকুয়িড খাবার না খেলে, ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না রাখলে রোগী শকে চলে যায়।”
“এ বছর ডেঙ্গুর ডেন ১, ৩ ও ৪ সেরোটাইপে আক্রান্ত হচ্ছে রোগীরা। সে কারণেও রোগী দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু হলে বেশি বেশি করে লিকুয়িড খাবার খেতে হবে, প্রেশার কমছে কিনা তা দেখতে হবে আর বেশি বেশি বমি হলে, রক্তক্ষরণ হলে হাসপাতালে যেতে হবে।”
২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে এক গবেষণার তথ্য বলছে একজন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য গড়ে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা খরচ হয়।
এপিডেমিওলজিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক বার্ডেন অব ডেঙ্গু ইন ঢাকা, বাংলাদেশ” শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর গড় খরচ ছিল ২২,৩৭৯ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৪৭,২৩০ টাকা।
বিআইডিএস-এর স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক সরকার টিবিএসকে বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য, তাদের মোট পরিবারিক আয়ের প্রায় ১৩৯% এ খরচ।
ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক সরকার বলেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করতে কর্তৃপক্ষের উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, বিশেষ করে ডেঙ্গু সংক্রমণের মরসুম আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১০ জন, যা ২২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুসারে, রাজধানীতে ২,১৫৯ জন সহ মোট ৩,১৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ৫৮ জন মারা গেছে। এরপর দীর্ঘদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ এর নিচে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। সেসময় মারা গেছে ১৭৯ জন। ২০১৯ সালের পর চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে।
ডেঙ্গু রোগী আরো বেড়ে গেলে তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ’র নতুন হাসপাতাল ইউনিট এবং লালকুঠি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেলে তাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। তবে মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিতে পারবে ঠিকই কিন্তু এডিশ মশা মারতে পারবে না। মশা মারার কাজ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার।
তিনি বলেন, মশা কমলে ডেঙ্গু রোগীও কমে যাবে; হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপও কমে যাবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার
ডেঙ্গু নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার পাশাপাশি টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে করোনার মতো মহামারি আকারে রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু। একইসঙ্গে জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি সারা দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং মৃত্যু গত ২২ বছরে বেড়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সারা দেশ থেকে আক্রান্ত রোগীরা ঢাকায় আসছেন। আক্রান্তদের সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, দুটো কারণে ডেঙ্গু বেড়েছে। প্রথমটি হলো এবার বৃষ্টির মৌসুমটা দীর্ঘ হয়েছে। যেহেতু এডিস মশার প্রজননে পানি প্রয়োজন তাই বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এর একটি সংযোগ রয়েছে। অনেক সময় দেখেছি ফেব্রুয়ারি-মার্চে বৃষ্টি হওয়ায় তখন কিন্তু সংক্রমণ বেড়েছে।
২০০০ সালে প্রথম সংক্রমণ শুরু হয়। এখন ২০২২ সাল। অর্থাৎ গত ২২ বছরে এই সমস্যাটি আমাদের বারবার ফেস করতে হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এবং এটার উন্নয়নের জন্য টেকসই এবং কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমরা যা কিছু করেছি তা সবই হলো এডহক বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ফলে বড় কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নগরপিতারা বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন। জরিমানা করছেন। কিন্তু এটাতে কাজ হবে না।
ডেঙ্গু বাহকবাহিত রোগ। এখানে কীটতত্ত্ববিদদের সক্ষমতা অনেক বাড়াতে হবে। যাদের কাজ হবে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করা। জরিপ করা। ঢাকা যেহেতু বিরাট একটি নগরী সে হিসেবে জনসংখ্যাও বহুগুণ বেশি। কাজেই এখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক কীটতত্ত্ববিদ, ল্যাবরেটরি থাকা প্রয়োজন। যেখানে হাতেগোনা দু’একজন কীটতত্ত্ববিদ রয়েছে। যাদের পক্ষে এত বড় মহানগরীর জন্য কার্যকর কিছু করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের মোটাদাগে টেকসই এবং কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যা প্রয়োজন তা করিনি।
গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি থাকলে আমাদের জ্ঞানটা বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু আমাদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই। অনুমানের ওপরে আমরা কাজ করছি। সিটি করপোরেশনের কিছু মশক নিধন কর্মী আছে আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। আইইডিসিআরের সাবেক এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, এটাকে আমরা বলি নগরায়ণের রোগ। ঢাকার বাইরে আমাদের যে অন্য জেলা শহর আছে সেখানে আদৌ কোনো সক্ষমতা আছে কিনা জানা নেই।
আমাদের প্রায় সাড়ে ৩শ’ এর মতো পৌরসভা রয়েছে। নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে মশা এবং সংক্রমণও বাড়বে। তার জন্য কি আমাদের কোনো ব্যবস্থা আছে? নেই। তিনি বলেন, এখন আমাদের যেটা দরকার তা হলো ‘জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কর্মকৌশল’। এবং সেটার মূল ভিত্তি হবে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। এটা বাড়াতে কীটতাত্ত্বিক এবং এর সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি, কীটনাশক থাকতে হবে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গুর জন্য ল্যাবরেটরি থাকতে হবে। যেখানে স্থানীয়ভাবে গবেষণা হবে। এটার জন্য বড় আকারে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা ও গণজাগরণ তৈরি করতে হবে। একইভাবে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। স্থানীয় সরকার, সচিব মন্ত্রীর এ বিষয়ে আমরা কোনো বিবৃতি দেখি না। উল্টো বলা হয় ‘বাংলাদেশ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব রোল মডেল’।
এক্ষেত্রে জেলা উপজেলা পর্যায়ে তাদেরকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যেমন গোদ রোগ, কালা জ্বর দূর করতে পেরেছি। একইভাবে আমরা যদি গ্রামে এটা করতে পারি শহরে কেন পারবো না। গত ২২ বছরে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারলে ডেঙ্গু সংক্রমণ আজকের এই পর্যায়ে আসতো না।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১৫
আপনার মতামত জানানঃ