কোনো হিংসাত্মক ঘটনায় হাত বা পায়ের হাড় ভেঙে গেছে৷ তীরের আঘাতে মাথার খুলিতে ছিদ্র হয়ে গেছে৷ হাজার বছরের পুরানো হাড়গোড় নৃশংস এক অপরাধের ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে৷
মূলত প্রায় ৯,০০০ বছর আগে স্পেনের পর্বত এলাকায় এক গোষ্ঠী নৃশংস হত্যালীলার শিকার হয়েছিল৷ প্রত্নতাত্মিক ও নৃতত্ত্ববিদরা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে গত দশ বছর ধরে সেই রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
নৃতত্ত্ববিদ কুয়র্ট আল্ট উদাহরণ হিসেবে একটি নমুনা তুলে ধরে বলেন, ‘‘ইনি একজন বয়স্ক নারী৷ ভিতর থেকে তার মাথার খুলির দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে তীর কত দ্রুত গতিতে প্রবেশ করেছিল৷ খুলির একটা অংশ ফেটে গিয়েছিল৷”
স্পেনের পিরেনিজ পর্বতে এল্স ট্রক্স নামের এক গুহার মধ্যে এই সব কঙ্কাল ও হাড়গোড় পাওয়া গেছে৷ গত দশ বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখানে এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন৷
জার্মানির নৃতত্ত্ববিদ কুয়র্ট আল্ট শুরু থেকেই সেই প্রকল্পে প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষ বিশ্লেষণের দায়িত্ব পালন করছেন৷
কুয়র্ট আল্ট সে বিষয়ে বলেন, ‘‘সেখানে যে এক গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছিল, সেটা অবশ্যই বিস্ময়ের কারণ৷ আমরা জানি, সব প্রাপ্তবয়স্কদের হত্যা করা হয়েছিল৷ কঙ্কালের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ মানুষের হাড়ও ভেঙে দেয়া হয়েছিল৷ শিশুরাও হিংসার শিকার হয়ে মারা গিয়েছিল৷ সবশেষে মৃতদেহগুলি গুহার মধ্যে এনে ফেলে রাখা হয়েছিল৷”
কিন্তু নিহত মানুষগুলির পরিচয় কী? ডানিয়ুব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে কুয়র্ট আল্ট ও তার সহকর্মী নিকোল নিকলিশ গুহায় পাওয়া হাড়গোড় পরীক্ষা করেছেন৷
সবার আগে তারা টেম্পোরাল হাড়ের ভেতরের অংশের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেন৷ আল্ট বলেন, ‘‘মাথার খুলির অবস্থা ভালো থাকলে হাড়ও বেশ অক্ষত থাকে৷ ভেতরে তাকালেই তা বোঝা যায়৷ হাত, পা, পাঁজরের হাড়ের তুলনায় সেই অংশে ডিএনএ অনেক ভালো অবস্থায় পাওয়া যায়৷”
ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গেল যে সেই মানুষগুলি আদৌ সেই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন না৷ প্রায় ৯,০০০ বছর আগে প্রাচ্যের কিছু কৃষক মধ্য ইউরোপে চলে এসেছিলেন৷ শেষে তারা আজকের স্পেনে এসে বসতি গড়েন৷ এল্স ট্রক্স গুহায় পাওয়া আটটি দেহাবশেষ সেই কৃষকদের ছিল৷
নতুন বাসভূমিতে তারা মোটেই একা ছিলেন না৷ স্থানীয় ‘হান্টার-গ্যাদারারদের’ সঙ্গেও তাদের দেখা হয়েছিল৷ এল্স ট্রক্স এলাকায় কি এই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত ঘটেছিল?
তাদের মধ্যে আটজন মেষপালক হিসেবে পাহাড়ে প্রাণী চরাতে যেতেন৷ সেই গোষ্ঠীর মধ্যে বয়স্ক মানুষ ও শিশু ছিল৷ গ্রীষ্মকালে তরুণ ও বলিষ্ঠ মানুষগুলি উপত্যকায় চাষবাস করার সময় বয়স্ক ও শিশুরা পাহাড়ে গবাদি পশু চরাতে যেত৷
কিন্তু কারা এই মানুষগুলিকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল? প্রত্নতাত্ত্বিকরা গুহার মধ্যে আততায়ীদের কোনো চিহ্ন এখনো পান নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও কুয়র্ট আল্টের মনে একটা সন্দেহ রয়েছে৷
কুয়র্ট আল্ট বলেন, ‘‘অবশ্যই এটা আমাদের নিছক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সম্ভবত এই কৃষকদের সঙ্গে পাহাড়ের উপরে শিকারী ও সংগ্রহকারী গোষ্ঠীর দেখা হয়েছিল৷ তারাই কৃষকদের হত্যা করে৷ সেই ঘটনার নৃশংসতাই এমন সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে দিচ্ছে৷”
আততায়ীরাও সম্ভবত কৃষক ছিল৷ কিন্তু সেটা হলে কি তারা এত দক্ষতার সঙ্গে এমন নৃশংসভাবে হত্যালীলা চালাতে পারতো? আততায়ীদেরও হাড়গোড় পাওয়া গেলে কুয়র্ট আল্ট হয়তো সেই রহস্যের সমাধান করতে পারতেন৷ কিন্তু যতকাল না সেগুলি পাওয়া যায়, ততদিন এল্স ট্রক্স গুহার ঘটনার সুরাহা হবে না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ