রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরসহ ৮ জনকে দায়মুক্তি দিয়ে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বুধবার(১৯ অক্টোবর) সকালে আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার একজন সহকারী উপপরিদর্শক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গত ১২ অক্টোবর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা গোলাম মুক্তার আশরাফ উদ্দিন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও হত্যায় আনভীর ও অন্যান্যদের সংশ্লিষ্টতা পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তা। আমি বিস্তারিত তদন্ত করে দেখেছি, আত্মহত্যার সময় আনভীর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেছে কিন্তু জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে কারণে আমি “তথ্যগত ভুল” উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।
মামলাটির বাদী নুসরাত জাহান জানান, চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এমনকি মামলা দায়ের করার পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি এবং আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে তাকে জানাননি। তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়ে আমি আদালতে নারাজি আবেদন করবো।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এমনকি মামলা দায়ের করার পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি এবং আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে তাকে জানাননি।
গত বছরের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন রাতেই তার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেন। এই মামলায় গত বছরের জুলাইয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
ডিবির দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত বছরের ১৮ আগস্ট গ্রহণ করেন ঢাকার সিএমএম আদালত। আদালতের আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি পান একমাত্র আসামি সায়েম সোবহান।
পরে মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে নতুন মামলা করা হয়। তার বোন নুসরাত গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আটজনের বিরুদ্ধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এ নালিশি মামলাটি করেন।
মামলাটি গুলশান থানাকে এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
মামলায় সায়েম সোবহান ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান, তার স্ত্রী আফরোজা সোবহান এবং সায়েমের স্ত্রী সাবরিনাকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন—সাইফা রহমান, ফারিয়া মাহবুব, শারমিন ও ইব্রাহিম আহমেদ। পরে এই মামলায় সাইফা ও ফারিয়াকে গ্রেপ্তার দেখায় পিবিআই।
বাদী নুসরাত এজাহার থেকে জানা যায়, গত ১লা মার্চ মুনিয়াকে প্ররোচিত করে আসামি সায়েম সোবহান আনভীর বাসা ভাড়া নিতে বাদী নুসরাত ও তার স্বামীর পরিচয়পত্র নেন। ফুসলিয়ে তিনি মুনিয়াকে ঢাকায় আনেন।
তিনি গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে বাসা (ফ্ল্যাট-বি-৩) ভাড়া নেন। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি ও তার (বাদীর) বোনের স্বামী-স্ত্রীর মতো ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখে। আসামি বাসায় আসলে কক্ষটি পরিপাটি করে রাখা হতো।
এজাহারে বলা হয়, বোনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তাকে বিয়ে করে বিদেশে স্থায়ী হবে। কারণ, দেশে থাকলে আসামির বাবা-মা আসামিকে কিছু না করলেও তার বোনকে মেরে ফেলবেন। ১লা মার্চ থেকে আসামি মাঝে মাঝে ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন।
২০২০ সালে আসামির পরিবার এক নারীর মাধ্যমে এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারে। এরপর আসামির মা মুনিয়াকে ডেকে ভয়ভীতি দেখান এবং মুনিয়াকে ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আসামি কৌশলে (বাদী নুসরাতের) বোনকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন।
এতে বলা হয়, ২৩ এপ্রিল মুনিয়া তাকে ফোন করেন। মুনিয়া তাকে বলেছেন, আনভীর তাকে বকা দিয়ে বলেছেন, কেন তিনি (মুনিয়া) ফ্ল্যাট মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি পিয়াসা দেখেছেন। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক বন্ধু। এখন পিয়াসা তার মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন। এসময় আনভীর মুনিয়াকে বলে তোমার আর এইখানে থাকার দরকার নাই। তুমি কুমিল্লায় চলে যাও। আমি দুবাই চলে যাচ্ছি। কারণ আম্মা জানতে পারলে তোমাকে মেরে ফেলবে।
এজাহারে নুসরাত বলেন, দুদিন পর ২৫শে এপ্রিল মুনিয়া তাকে ফোন করেন। ওই সময় তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন। আসামিকে উদ্ধৃত করে মুনিয়া বলেন, আসামি তাকে বলেছেন, তিনি (মুনিয়া) তার শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না।
মুনিয়া চিৎকার করে বলেন, আসামি তাকে ধোঁকা দিয়েছেন। যেকোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
পুলিশ সূত্র বলছে, আসামির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টার মধ্যে যেকোনো সময় মুনিয়া মারা যান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা দেখেছি, প্রভাবশালীদের দিকে আইন একটু হেলে পড়ে৷ সেটা অর্থশালী হোক আর ক্ষমতার দিক দিয়ে প্রভাবশালী হোক অথবা পেশি শক্তির অধিকারীই হোক৷ এটা কোনভাবেই কাম্য নয়৷ এই অবস্থা চলতে থাকলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা এক সময় শেষ হয়ে যাবে৷ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন থাকাটা জরুরি৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২২৪
আপনার মতামত জানানঃ