ঢাকার একজন কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর বেশ কিছুকাল ছিলেন সংবাদ শিরোনামে। তবে একটা কথা প্রচলিত আছে, ’রিচ পিপল আর নেভার আগলি’। বেশ কিছুদিনের নাটকীয়তা শেষে তাই সেই মামলা থেকে মুক্তি পান তিনি। যা মূলত শুরু থেকেই বেশ অনুমিত ছিল। তবে আবারও সংবাদের শিরোনামে আসতে চলেছেন আনভীর। যদিও সন্দেহ আছে কতটা লাইম লাইটে আসবে তার এই নতুন কীর্তি! কারণ গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ আনভীরদের কাছে মাথা বন্ধক দিয়ে রেখেছে। তবে এবার শুধু আনভীর নয়, তার দোসর হয়েছেন ইয়াশা সোবহান; যিনি মূলত বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক।
অর্থনীতির শেরপা খ্যাত আনভীর আর ইয়াশা সোবহানের নতুন কীর্তির আগে একটা প্রসঙ্গে বলে নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করার পথে একটি বড় বাধা হলো বিদেশে অর্থ বা পুঁজি পাচার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকেই দেশে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করতে থাকে, যা পরবর্তীকালে সেনাশাসনে আরও প্রকট হয়। বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে বিদেশে অর্থ পাচার যেন একটি ওপেন সিক্রেট। তবে বিগত শতাব্দীর ’৮০ বা ’৯০-এর দশকে ‘মানি লন্ডারিং’ এতটা খোলামেলা ছিল না। নিজ দেশে অর্থসম্পদ রাখা নিরাপদ নয় বিবেচনায় দুর্নীতিবাজ ও অবৈধভাবে দেশীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীরা অর্থ পাচার করে তা বিদেশি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে কিংবা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে।
জিএফআই’র সর্বশেষ প্রচারিত রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮২ হাজার ১১০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৭৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ৯৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। গত দুই বছরের মুদ্রা পাচারের চিত্র আরও ভয়াবহ বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
আর এই ধারণাকেই নতুন চেহারা দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ও পরিচালক ইয়াশা সোবহান। এই দুইজনই বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে স্লোভাকিয়া ও সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব কিনেছেন। এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে স্টেট ওয়াচের কাছে। যা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিতর্কিত ও অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অর্থের বিনিময়ে এমন নাগরিকত্ব কিনে থাকেন।
সূত্র মতে, স্লোভাকিয়া এবং সাইপ্রাসের পাসপোর্ট কিনতেই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও পরিচালক ইয়াশা সোবহান খরচ করেছেন যথাক্রমে ৩ মিলিয়ন ইউরো বা ৩০ কোটি টাকা এবং ২ মিলিয়ন ইউরো বা ২০ কোটি টাকা। এর বাইরেও যে তারা বিপুল অঙ্কের টাকা দেশ দুটিতে পাচার করেনি, সেটা জোর গলায় বলায় উপায় নেই।
এখানে উল্লেখ্ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি পাসপোর্টে বিনিয়োগের কোন সুযোগ নেই। এছাড়াও সায়েম সোবহান আনভীর দেশের একজন সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইম্পর্টেন্ট পার্সন)। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা CIP উচ্চ মর্যাদার বাণিজ্যিক ব্যক্তিত্বদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে সিআইপিদের ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে এমন একটি মুহূর্তে যখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এমন সময় দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের দুই পরিচালকের শুধু পাসপোর্ট সংগ্রহে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। বড় কোন ঘটনা কি ঘটার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশে?
অনুসন্ধানে জানা গেছে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্লোভাকিয়ায় নাগরিকত্ব পাওয়া বিশ্বের সব চাইতে ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে বেশ শক্ত কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলোর মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো নাগরিকত্বের জন্যে ৩ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ইউরো দেশটিতে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে ও দ্বিতীয় শর্ত হলো সেসব ব্যবসায় অন্তত ৩০০ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। এদিকে, সাইপ্রাসে নাগরিকত্ব পেতে অন্তত ২.২ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করতে হবে।
সূত্র মতে, স্লোভাকিয়ার একটি কোম্পানির ডিরেক্টর পদে আছে আনভীর। কোম্পানিটির নাম ওয়ার্ডেরা করপোরেশন (Wordera Corporation. ICO Number: 47955414. Date of Entry: 11/052014)। কোম্পানিটির অংশীদার হলেন বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও সাবরিনা সোবহান। এই কোম্পানিটির মূলধন ১ মিলিয়ন ইউরো।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করেছে, তারা কাউকেই বিদেশে নাগরিকত্ব কিনতে কোন রকমের অর্থ লেনদেনের অনুমোদন দেননি। তাহলে প্রশ্ন, কীসের ভিত্তিতে বা কী উপায়ে বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার ভাইয়ের স্ত্রী ৫ মিলিয়ন ইউরো বা ৫০ কোটি টাকা বৈদেশিক নাগরিকত্বে বিনিয়োগ করলেন! বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন বৈধ উপায় নেই বিদেশে বিনিয়োগের। তাই অন্যভাবে বললে এই ঘটনাকে অর্থ পাচার বলেই চিহ্নিত করা যায়।
আর অবৈধ উপায়ে বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের ঘটনা নতুন নয়। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা ও অপরাধীরা প্রায়ই অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন। এমন ঘটনা সাইপ্রাসেও ঘটেছে এবং তা খুব সম্প্রতিই। ২০২০ সালের জুলাইয়ে আল জাজিরার অনুসন্ধানী দলের এক তদন্তে জানা যায়, সাইপ্রাসের সাবেক প্রেসিডেন্টসহ চারজন বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রোগ্রামে দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেদনটি উন্মোচন করে কিভাবে এ সকল ব্যক্তিরা দেশটিতে চীনা, রাশিয়ান অপরাধীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য অবৈধ পথ অবলম্বন করেছিলেন।
সায়েম সোবহান আনভীর ও ইয়াশা সোবহান এ ধরণের অপরাধী না হলেও, অবৈধপথে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে এবং দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসরন না করে বিদেশি পাসপোর্ট ক্রয় করা বেশ গুরুতর অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। মূলত সোবহানদের মতো রাঘববোয়ালদের এই ধরণের অর্থপাচারের মত দুর্নীতির কারণেই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি ধুকছে।
এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি বড় উপায় হচ্ছে বাণিজ্য কারসাজি। আরেকটি উপায় হচ্ছে হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোন পণ্য আমদানি করা হয়,তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে থেকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা একটি সাক্ষাৎকারে জানান, এগুলো ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং হিসেবে পরিচিত। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। খুব প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোন একটি পণ্যের দাম যত হবার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেয়া হয়।
যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক এটা নিশ্চিত করেছে, যে তারা এই ধরণের বিনিয়োগের কোনও অনুমতি দেয়নি, সেহেতু বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও পরিচালক ইয়াশা সোবহানের এই ধরণের নাগরিকত্ব গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। অবশ্য দেশের বিচার ব্যবস্থার নানা ফাঁক-ফোঁকর বের করে এই অলিগার্কেরা ঠিকই পার পেয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে কলেজ ছাত্রী মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন।
আপনার মতামত জানানঃ