সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী, এমন দাবি করে প্রায় কয়েকশো পোস্ট ফেসবুকে করা হয়েছে। কিন্তু এটা সত্য নয়, গুজব। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র জানান, এমন কোন ঘোষণা দেওয়া হয়নি। অক্টোবর ১৬, ২০২২ সাল অব্দি এমন কোন অফিশিয়াল প্রতিবেদন নেই। ফরাসি সংবাদ সংস্থা AFP এর এক ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি এই দাবি করা হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ করা একটি ফেসবুক পোস্টে। পোস্টে শেখ হাসিনার ছবিও ছিল। পোস্টটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমপি জাহিদ মালেকের আনভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে করা হয়। তবে এই পেজটিকে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যবিভাগ ফেসবুকে প্রমোট করে থাকে।
পোস্টটিতে উল্লেখ আছে, অভিনন্দন! শেখ হাসিনা, আমাদের সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী, সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং লাখো মানুষের নেত্রীকে জাতিসংঘের দ্বারা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়েছে।
এই একই ধরণের একটি পোস্ট ওই একই দিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালিত নিউজ এজেন্সি বিএসএসও শেয়ার করেছিল।
বিএসএসে উল্লেখ করা হয় বীর বাহাদুর উশৈ সিং, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী লেখেন, জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী। এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।
উল্লেখ্য, এই পোস্ট আরও বিভিন্ন জায়গায় শেয়ার হয়েছে।
আগেও উঠেছিল এই দাবি
তবে এই প্রথম নয়; এই পোস্ট প্রথম ফেসবুকে শেয়ার হয় ২০১৮ সালে। ১৬ মার্চ ২০১৮ তারিখ ekattornews24.com নামক একটি নিউজ পোর্টাল “বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। প্রায় একই সাথে newsbangla21.com.bd নামক আরেকটি নিউজ পোর্টাল “দ্য স্টাটিসটিক্স ইন্টারন্যাশনাল জরিপে শেখ হাসিনাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো নতুন তথ্য” শিরোনামে নিউজ করে। নিউজ দুটি হুবহু একই রকম।
এগুলোতে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। এই তালিকার প্রথমে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। দক্ষ নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলী, মানবিকতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নসহ ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আলোচনায় থাকার বিষয় বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য স্টাটিস্টিকস ইন্টারন্যাশনাল’ নিজেদের করা এক জরিপ শেষে এই ঘোষণা দেয়।”
এ নিউজ দুটি ১৬ মার্চ প্রকাশ হলেও ১৯ মার্চ পর্যন্ত এই বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি। ১৯ মার্চ ২০১৮, সোমবার, মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর মন্ত্রীপরিষদ সচিব শফিউল আলম সাংবাদিকের ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করায় মন্ত্রীসভা প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করছে।
ব্রিফিংয়ে এ সম্পর্কে তার পুরো বক্তব্যই মূলত ছিলো ekattornews24.com এর হুবহু নকল। বলার অপেক্ষা রাখে না, মন্ত্রীপরিষদ সচিবের ব্রিফিং কিংবা মন্ত্রীসভার সদস্যদের অভিনন্দনের মূল উৎস ছিলো এই অখ্যাত একাত্তরনিউজ২৪ অনলাইন পোর্টালটি।
এরপরপরই প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম মন্ত্রীপরিষদ সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী সংবাদ প্রকাশ করে এবং এটি ভাইরাল হয়ে যায়। এ সংবাদ মাধ্যমগুলোর মধ্যে বিডিনিউজ২৪ডটকম, বাংলা ট্রিবিউন, চ্যানলে আই অনলাইন, ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি অবজার্ভারের মতো সংবাদ মাধ্যমও ছিল। এছাড়াও প্রায় ৫০ টির বেশি অনলাইন পোর্টাল এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।
সত্যতা যাচাই
দ্য স্টাটিসটিক্স ইন্টারন্যাশনাল নামক কথিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি একটি অস্তিত্বহীন কাল্পনিক সংস্থা। উল্লেখিত সংবাদ এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিবের বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষণা সংস্থা বলে দাবি করা হলেও, ইন্টারনেটে এই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনও ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি।
পাওয়া যায়নি তাদের অফিসের ঠিকানা, ইমেইল ঠিকানা কিংবা কোনও ফোন নম্বর। ফেসবুক টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই প্রতিষ্ঠানের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও উল্লেখিত সংবাদ অনুযায়ী, এ জরিপে প্রথম হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তৃতীয় হয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। কিন্তু ভারতের কোনও নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমে দ্য স্টাটিসটিক্স কর্তৃক নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বের সেরা প্রধানমন্ত্রীর খেতাব দেওয়া সংক্রান্ত কোনও সংবাদ প্রকাশ হয়নি।
স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, একাত্তরনিউজ২৪ ইচ্ছাকৃতভাবেই ভারত ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর নাম দিয়ে সংবাদটিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করেছে।
উল্লেখ্য, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এ ধরনের বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করেছিলো ‘বাংলা ইনসাইডার‘ নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে করা বাংলা ইনসাইডারের বানোয়াট সংবাদ নিয়ে জাতীয় সংসদে (দশম সংসদের ১৮ তম অধিবেশনে) আলোচনা করেন একজন সংসদ সদস্য। ক্রমাগত বানোয়াট ও কাল্পনিক সংবাদ পরিবেশন করার পরও বাংলা ইনসাইডারকে সম্মুখীন হতে হয়নি কোন প্রশ্নের।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১৭
আপনার মতামত জানানঃ