বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, পুলিশ ও দুর্বৃত্তদের গুলিতে বিএনপি নেতাদের মৃত্যু, হামলা ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে শনিবার দুপুর ২টায় ময়মনসিংহে বিভাগীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। আজ ময়মনসিংহ পলিটেকনিকাল ইনস্টিটিউট মাঠে এ গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
নগরীর পলিটেকনিক মাঠে বিকালের এই সমাবেশস্থলে ইতিমধ্যে বিভাগের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিলসহ সমাবেশস্থলে জড়ো হচ্ছেন। তবে গণপরিবহণ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন তারা পথে পথে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। সমাবেশেকে ঘিরে পলিটেকনিক মাঠে এখন উৎসবের আমেজ।
পথে পথে নির্যাতন
নেত্রকোনার পারলা বাসস্ট্যান্ড থেকে শ্যামগঞ্জ মোড় পর্যন্ত যেতে অন্তত চারটি স্থানে পুলিশের চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। বন্ধ আছে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব ধরনের যান। অটোরিকশাযোগে যারা বিভিন্ন কাজে শহরে যেতে যাচ্ছেন তাদেরও চেক করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাদা পোশাকে ডিবি ও থানা পুলিশ তাদের গাড়ি চেক করছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করার নামে হয়রানি করা হয়েছে। এতে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হতে পারেননি। সমাবেশে আসা অনেকগুলো গাড়িকে মাঝপথে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন খান রণি জানান, সকালে দলের নেতাকর্মীরা যখন রওনা দেন তখন ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের গাড়ি আটকায়। তারা কোথায় যাবেন, কেন যাবেন এবং তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছেন। পরে কয়েকটি গাড়ি ছেড়ে দিলেও বেশকিছু গাড়ি আটকে দেয়। তবে তাদের ওপর কোনো হামলার ঘটনা না ঘটলেও নানাভাবে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ড. রফিকুল ইসলাম জানান, জেলার দশ উপজেলা থেকেই নেতাকর্মীদের আসতে পথে পথে পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার ভয় পেয়ে শুক্রবার দুপুর থেকে বাস সহ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। নেতাকর্মীদের চেক করে টাকা পয়সা রেখে তাদের হেনস্থা করেছে। এ ছাড়া গতকাল রাতে যারা হোটেলে ছিলেন সেখানে পুলিশ তাদের তল্লাশি করেছে এবং নানাভাবে হয়রানি করেছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
বাস চলাচল বন্ধ
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ও শ্রমিকেরা। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এ পথের যাত্রীরা।
তবে পরিবহন মালিকদের দাবি, আজ (শনিবার) ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ রয়েছে। এ সমাবেশে পরিবহন বা বাসে হামলা-ভাঙচুরের আশঙ্কা রয়েছে। তাই তারা আজ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী সব বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন।
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহগামী বাস যাত্রী পরিবহন করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজ শনিবার সকাল থেকে এই টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। তবে সকাল থেকে টার্মিনালটিতে ময়মনসিংহগামী যাত্রীদের ভিড় হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সামদানী খন্দকার বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপি সমাবেশ শেষে পরিবহন শ্রমিকদের ওপর হামলা এবং বাস ভাঙচুর করা হয়েছে। আজ ময়মনসিংহে বিএনপি সমাবেশে একই ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এই রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন মালিকরা।
বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছে সন্দেহে শ্রমিককে কুপিয়ে জখম
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছেন, এমন সন্দেহে এক শ্রমিককে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে গফরগাঁও উপজেলার উথুরি মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।
জখম হওয়ার ব্যক্তির নাম মো. মোবারক হোসেন (৩৩)। তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার আলুদ্দিয়া গ্রামে। তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে শ্রমিকের কাজ করেন।
গাড়ি দিয়ে আসার পথে গফরগাঁও উপজেলার উথুরি মোড়ে রামদা হাতে একদল দুবৃর্ত্ত তাদের পথ রোধ করে। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ময়মনসিংহে বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছে সন্দেহ করে সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করতে শুরু করে।
তিনি জানান, কমিউনিটি সেন্টারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ করেন। নিয়মিতভাবে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলায় থাকেন। আজ শনিবার সকালে মোট ১২ জন শ্রমিক কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর হয়ে গফরগাঁও উপজেলায় যাচ্ছিলেন। গফরগাঁওয়ে কাদির কমিউনিটি সেন্টারে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে কাজ করার কথা তাদের। টমটম নামের এক ধরনের গাড়ি দিয়ে আসার পথে গফরগাঁও উপজেলার উথুরি মোড়ে রামদা হাতে একদল দুবৃর্ত্ত তাদের পথ রোধ করে। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ময়মনসিংহে বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছে সন্দেহ করে সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করতে শুরু করে। একপর্যায়ে মোবারকের ডান হাতে রামদা দিয়ে কোপ দেওয়া হয়। আহত অবস্থায় মোবারকে গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
মোবারক আরও বলেন, ‘আমার বাড়ি নেত্রকোনায়। কিশোরগঞ্জ শহরে থাকি। গফরগাঁও উপজেলার কোনো মানুষকে আমি চিনি না। আমাদের কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মারধর করতে থাকে।’ চিকিৎসক তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বললেও তিনি গফরগাঁওয়ে অবস্থান করছেন বলে জানান মোবারক।
সড়কে লাঠি হাতে আ.লীগের লোকজন
বিএনপির ডাকা সমাবেশে কর্মী সমাগম ঠেকাতে যান চলাচল বন্ধের পর সড়কে সরব হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোকজন। কোথাও লাঠি হাতে, কোথাও মিছিল নিয়ে সড়কে অবস্থান করছেন তাঁরা। এ সময় গাড়ি তল্লাশি, গাড়ির চালককে মারধরসহ যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আজ শনিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ত্রিশাল বাজার পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট সরেজমিন এ চিত্র পাওয়া গেছে। যারা ছিলেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের লোকজন।
বেলা ১১টার দিকে মহাসড়কের ত্রিশাল বাজারের সামনে ২০০ নেতা-কর্মীর জটলা ছিল। তাদের কারও হাতে লাঠি, কেউবা দাঁড়িয়ে আছেন কাঠের টুকরা নিয়ে। তাঁরা অবস্থান করছেন সড়কের ঠিক মাঝখানে। এর মধ্যে কোনো ট্রাক, পিকআপ বা ছোটখাটো যাত্রীবাহী বাস আসতে দেখলেই পথ আটকে ধরছেন তারা। যানগুলো তল্লাশি করে তারা যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
জানা যায়, কোনো যানবাহন তাদের সামনে এলেই বিএনপিবিরোধী স্লোগান আর মিছিল নিয়ে ওই যানবাহনকে ঘিরে ধরছেন তারা। এ সময় বিএনপির কোনো কর্মী বা নেতা সমাবেশে যাচ্ছেন কি না, দেখতে পুরো গাড়ি তল্লাশি করছেন। কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির ওপর বেশ মারমুখী হয়ে উঠেছে; এই প্রশ্ন এখন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিরোধীদল বিএনপি যতগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে, দলটির নেতারা বলছেন যে তার বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছে। বিএনপির নেতারা আরও অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বিরোধীদলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এই বিরোধ আরও বাড়বে।
তাদের যুক্তি হলো, আওয়ামী লীগ মোটামুটি ধরে নিয়েছে যে বিএনপি মুখে যাই বলুক, তারা নির্বাচন করবে এবং নির্বাচন করার জন্য তারা সিরিয়াস। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সভা-সমাবেশগুলোতে প্রচুর মানুষের উপস্থিতির বিষয়টিও এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রাখছে বলেও তারা মনে করেন।
তারা বলেন, যেখানেই তারা (বিএনপি) অল্প সময়ের ঘোষণায় মিটিং করে, সেখানে কিন্তু অনেক লোকজন হয়। এতে আওয়ামী লীগ কিছুটা বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেছে। সব দিক বিচার করলে মনে হয়, এই সমস্যা বা বিরোধ আগামীতে আরও বাড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১১
আপনার মতামত জানানঃ