এছাড়া পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবেও নারীকে ধর্ষিত হতে হয়। আমরা এসবকে নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতন এবং নারীর সম্ভ্রমহানি বলে আখ্যায়িত করছি। কিন্তু ধর্ষণের মতো অপরাধকে নারীর সম্ভ্রমহানি বলে যা বোঝাতে চাই তা কি যথার্থ?
নারীর সম্ভ্রমহানি বললেও প্রকৃতপক্ষে এই সম্ভ্রমহানি মানুষের, সমাজের, রাষ্ট্রের তথা মানবজাতির। ফলে একজন নারীর সম্ভ্রম হারাল তো মানবজাতিই সম্ভ্রম হারাল, মানবতা সম্ভ্রম হারাল। যারা নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয় তারা পক্ষান্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করে। কাজেই এদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগও আনতে পারে রাষ্ট পক্ষান্তরে সরকার।
তবে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে কথিত সম্ভ্রমহানির বিষয়টি সামনে এনে নারীকে আরও বিপন্ন করে তোলা হয়। এর মাধ্যমে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধটি হালকা হতে থাকে। ধর্ষণে অভিযুক্তও এক ধরনের দায়মুক্তির সুযোগ পান।
ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির দেয়া এক বক্তব্যের প্রশংসা করেছেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, সমাজে কথিত সম্ভ্রমহানির বিষয়টি সামনে এনে ধর্ষণের শিকার নারীকে আরও বিপন্ন করে তোলা হয়। এর মাধ্যমে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধটি হালকা হওয়ার পাশাপাশি ধর্ষণে অভিযুক্তও এক ধরনের দায়মুক্তির সুযোগ পান।
কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে সোমবার এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিষয়টি সামনে আনেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘কুকুর কামড় দিলে সম্ভ্রম যায় না, কিন্তু ধর্ষণের শিকার হলে সম্ভ্রম যায়! নিশ্চয় সম্ভ্রম নারীর কোনো বিশেষ অঙ্গে থাকে না। অতএব ধর্ষণের সঙ্গে সম্ভ্রমের কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, আমি কখনই মনে করি না তাদের সম্ভ্রমহানি হয়েছিল। তাদের একদল পশু নির্যাতন করেছিল। তাদের যদি কুকুরে কামড় দিত তাহলে নিশ্চয় আমরা বলতাম না সম্ভ্রমহানি হয়েছিল।’
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক।
তিনি বলেন, ‘এখানে (ধর্ষণ) তো মেয়ের ইচ্ছাতে কিছু হয়নি। এখানে তার কোনো দোষ নেই। তাহলে কেন সম্ভ্রমহানি শব্দটা আসবে? এখানে সে কোনোভাবেই দায়ী নয়। এখানে সম্ভ্রমহানির বিষয় থাকলে সেটা অবশ্যই ছেলেটার।’
সমাজ এ ধরনের প্রচার শক্তিশালী করেছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক তানিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করি, তারা মনে করি বিয়ের পর এই সম্পর্ক (শারীরিক) জায়েজ। এখন যে সম্পর্কে আমার কোনো মত ছিল না, আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বা জোর করা হয়েছে সেটা কখনোই সম্ভ্রমহানি নয়।’
অধিকারকর্মী খুশী কবিরও মনে করছেন, কোনো নারীকে যখন ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় তখন ওই নারীর নয়, বরং পুরুষটির সম্ভ্রমহানি ঘটে।
তিনি বলেন, ‘এখানে মেয়ে তো অ্যাকটিভ পার্টিসিপেন্ট নয়। কাউকে যখন হত্যা করা হয় বা হত্যার চেষ্টা করা হয় সেখানে যিনি এর শিকার তাকে তো কেউ দোষ দেয় না। তাকে কেউ সমাজচ্যুত করছে না বা বলছে না যে তোমার সম্ভ্রমহানি হয়েছে।
‘অথচ যিনি ধর্ষণ শিকার হন সমাজ ও পরিবার তাকেই বেশি ব্লেইম করে থাকে। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে হয়। তার মানে বিয়ের অর্থ আর মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
খুশি কবির বলেন, ‘একটা মেয়ের সম্ভ্রম কেন তার শরীরে থাকবে, সেটা থাকে তার ব্যক্তিত্বে। যে ধর্ষণ করেছে তাকে পয়েন্ট করতে হবে, কিন্তু সেটা করা হয় না।’
আমরাই পারি-এর প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ‘ধর্ষণ মানে মানুষকে শারীরিক আঘাত, মানসিক আঘাত, কিন্তু এর অর্থ এমন না যে আমার শরীরের সঙ্গে আমার সম্মান জড়িত।’
যুগে যুগে ধর্ষণকে ‘সম্ভ্রমহানি’ হিসেবে প্রচারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘একই জিনিস যখন ছেলেদের ক্ষেত্রে হচ্ছে যেটা বলাৎকার, সেখানে কিন্তু সম্ভ্রম শব্দ যুক্ত করা নেই। এ ক্ষেত্রে যেটা হয় ট্রমাটা থেকে যায়, কিন্তু ছেলেটার জীবন নষ্ট হয় না। তাকে স্টিগমাটাইজড করা হয় না।’
তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে কথিত সম্ভ্রমকে যুক্ত করে তার জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয় জানিয়ে জিনাত আরা হক বলেন, ‘বাংলাদেশে একটা ধারণা আছে যে, মেয়েদের ভার্জিন থাকতে হবে। সতী থাকতে হবে। আর এই সতী থেকেই সম্ভ্রম এসেছে। আর কথিত সতিত্ব নষ্ট মানেই সম্ভ্রমহানি হওয়া। এটা অনেকটা অনার কিলিংয়ের মতো।’
ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় পুলিশের কাজের পরিধি নিয়ে। শুধু কি থানায় অভিযোগ এলেই তারা তৎপর হবে? এর বাইরে সমাজে কোথাও অন্যায় কিছু হচ্ছে কি না, মানুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কি না তার খোঁজ নেওয়া কি পুলিশের কাজ নয়? এমন একটি জঘন্য ঘটনার এক মাস পরও কি পুলিশ জানতে পারল না তা? তাদের সোর্স কি এতই দুর্বল?
যে যুবকরা ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা কি এতই ক্ষমতাবান যে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ থাকল না একলাশপুরে? তারা এতই বেপরোয়া ও উদ্ধত যে ভিডিও ভাইরাল করার সময়ও তারা ভীত হয়নি।
এই যে ভীত না হওয়া এটাই দেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা বৃদ্ধির কারণ। এই ধরনের উদ্ধত আচরণ আমরা লক্ষ করি সিলেটের এমসি কলেজে সংঘটিত ঘটনার বেলায়ও। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না অথবা কয়েকদিন থানা-পুলিশ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা যেভাবেই হোক রেহাই পেয়ে যাবে।
পূর্বেই বলেছি, ধর্ষণের ঘটনা মোকাবেলা করা ধর্ষিতা বা তার পরিবারের পক্ষে সত্যিই কঠিন। অনেকেই জানেন সমাজ থেকে আদালত সবখানে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে অহরহ অবমাননাকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।
প্রথম প্রথম কয়েকদিন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতার কারণে পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে সহনশীল থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পক্ষে তখন কার্যত কেউ থাকে না।
আর এ ধরনের মামলায় আসামি বা দোষীদের উপযুক্ত সাজা প্রদানে পুলিশের যে ভূমিকা থাকার কথা তা থাকে না। দোষীদের চাপে বা অর্থের বিনিময়ে পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টে এমন ফাঁকফোকর রাখা হয় যে আসামি মামলা থেকে অনেক সময় রেহাই পেয়ে যায় নতুবা গুরু পাপে লঘু দণ্ড হয়।
অনেক সময় দোষীরা জামিনে বেরিয়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও তার পরিবারকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করে নতুবা মামলা পরিচালনায় অপারগ করে তোলে। এমন হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দোষীদের প্রকৃত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছিল কি না তা দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ