ইউরোপকে বলা হত উদারপন্থী গণতন্ত্রের দুর্গ। কিন্তু বিগত কয়েক দিন ধরেই উত্থান ঘটছে অতি-ডানপন্থী দলগুলোর। অভিবাসনবিরোধী, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ভালো করতে দেখা যাচ্ছে বিগত দিনগুলোতে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ইউরোপজুড়ে ডানপন্থার উত্থান ঘটছে, যার অবস্থান উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপরীতে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মুসলিম, ইহুদি, শরণার্থী-অভিবাসন, বহুত্ববাদ, উদারতাবাদ ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর, নেতিবাচক ও ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যায়।
যার ফল পরিলক্ষিত হয় পশ্চিমা দেশগুলোর পপুলিস্ট তথা লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য-বিবৃতিতে এবং নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনগুলোতেও। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এই শক্তি ইতোমধ্যে একাধিক দেশে সরকার গঠন করেছে।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশে কট্টর ডানপন্থি সরকার আগে থেকেই ক্ষমতায় রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে ফ্রান্সের সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পায় উদারপন্থি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দল ‘লা রিপাবলিকা এন মার্চ’। তবে মেরিন লা পেনের কট্টর ডানপন্থি দল ভোটের রাজনীতিতে নতুন রেকর্ড গড়ে, যা দেশটির মধ্যপন্থি রাজনীতিকে নাটকীয়ভাবে ডানপন্থার দিকে টেনে নিয়ে গেছে।
জার্মানিতে সবশেষ নির্বাচনে বামপন্থি এসপিডি জিতলেও, কট্টর ডানপন্থি দল এএফডি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এমনকি দলটি বর্তমান সরকারে অন্যতম বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে সুইডেনে অভিবাসনবিরোধী দল ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাট’ নতুন সরকার গঠন করেছে। মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করা এই দলের রয়েছে নব্য নাৎসিবাদী ইতিহাস।
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মতো গত কয়েক বছর ধরে অনেকটা অগোচরেই ডানপন্থার বিস্তার ঘটেছে ইতালিতেও। অবশেষে গত সপ্তাহের (২৫ সেপ্টেম্বর) জাতীয় নির্বাচনে তার প্রকাশ দেখল বিশ্ব। এ নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থি জোট বিশাল জয় পেয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জর্জিয়া মেলোনি নামে এক নারী রাজনীতিক। ফলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগামী চার বছরের জন্য ইতালি শাসন করবেন তিনিই। তার দল ব্রাদার্স অব ইতালি মাত্তিও সালভিনির লীগ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনির ফোরজা ইতালিয়ার সঙ্গে মিলে পেয়েছে মোট ভোটের ৪৪ শতাংশ। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থাৎ প্রায় গত ৭০ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো ঘটনা।
প্রকৃতপক্ষে গোটা ইউরোপজুড়েই ডানপন্থী দলগুলো অনেক দিন ধরেই শক্তিশালী হচ্ছিল।
ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট , জার্মানিতে এএফডি, হাঙ্গেরিতে ফিডেস, সুইডেনে এসডি, স্পেনে ভক্স পার্টি, অস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি, ইতালিতে লিগ এবং ব্রাদার্স অব ইতালি – এ তালিকা আদৌ ছোট নয়।
একেক দেশে একেক নামের দল হলেও এদির অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে। এরা সবাই কমবেশী জাতীয়তাবাদী, অভিবাসন বিরোধী, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসন বিরোধী এবং তাদের এ বিরোধিতা কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষী চেহারা নেয়।
ইউরোপজুড়ে তাদের জনপ্রিয়তা এত বাড়ছে কেন?
ফ্রান্সের এবং র্যালি ফর দ্য রিপাবলিক দলের সাবেক এমপি এবং রাজনীতিবিদ পিয়ের লেকিয়া বলছিলেন, এর একাধিক কারণ রয়েছে।
লেকিয়া বলেন, “নিশ্চিতভাবেই এর কোন একক কারণ নেই। আসলে অনেক মানুষই ইউরোপকে পুরোপুরি বোঝে না। এর কারণ ইউরোপের ভেতরেই রয়েছে। যেমন ফ্রান্সে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার, যা পূরণ হয়নি। সেসব সংস্কার করা হয়নি। মানুষ গরীব হচ্ছে, লোকের হাতে যথেষ্ট অর্থ নেই। জাতীয়তাবাদী দলগুলো এ পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। তারা অভিবাসনকে এ জন্য দায়ী করছে। কিন্তু আসলে অনেক কাজের সুযোগ আছে – যা ফরাসীরা করতে চায় না, এবং সে চাকরিগুলো অভিবাসীরা নিয়ে নিচ্ছে। জাতীয়তাবাদীরা বলছে, অভিবাসন বেড়ে গেছে – তারাই ফ্রান্সে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে, কিন্তু এসব কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
পিয়ের লেকিয়া বলেন, যদি ফ্রান্সের কথা বলি, ইইউ এবং অভিবাসন প্রশ্নে মারিন লা পেন আগে যে অবস্থান নিয়েছিলেন – তাতে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। একসময় তিনি কড়া ইইউ বিরোধী ছিলেন, কিন্তু সবশেষ নির্বাচনের সময় দেখা গেল ইইউ এবং অভিবাসনের ক্ষেত্রে তার অবস্থান অনেক নরম হয়েছে আসলে তাদের প্রভাব কখনো বাড়ে, কখনো কমে। জার্মানিতে একটা সময় চরম ডানপন্থী দলগুলো ভালো করছিল, কিন্তু এখন তাদের জনপ্রিয়তা আবার কমে যাচ্ছে।
সুইডেন এবং ইউরোপের সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে দুটি বই লিখেছেন লেখক ফ্রেডরিক সেগারফেল্ড।
তিনি বলছিলেন, শুধু ইউরোপ নয়, সারা বিশ্বেই ডানপন্থী রাজনীতি জোরদার হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন, “আমার মনে হয় এটি এক বৃহত্তর প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষ একধরনের শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব চাইছে। এটা শুধু ইউরোপে ঘটছে না, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, ব্রাজিল – এগুলো কয়েকটা উদাহরণ। এটা পৃথিবীতেই একটা প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে। তবে দেশে দেশে এর চেহারা ভিন্ন। তবে সাধারণভাবে তারা প্রগতিশীলতার বিরোধী। এরা বলছে, শহুরে জনগোষ্ঠী আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, পরিবর্তনের গতি খুব বেশি দ্রুত হয়ে গেছে , দেশের সাথে একাত্মতাবোধ কমে যাচ্ছে। যেমন, সুইডেনে এখন জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরই জন্ম হয়েছে অন্য কোন দেশে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটা ঘটে গেছে।”
মানুষজন মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, অভিবাসন এসব নিয়ে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা চায়। বামপন্থী দলগুলো এই সব মানুষদের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্যই তারা ডানপন্থীদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে।
“আমি নিজে বহুসংস্কৃতিবাদের ভক্ত। কিন্তু এখানকার অন্য অনেক লোকই এতে অস্বস্তি বোধ করে। তারা তাদের চারপাশে তাদেরই মত মানুষদের দেখতে চায়। একদিকে তারা প্রগতিশীলতার বিরোধী – কিন্তু অন্যদিকে আবার তাদের চোখে ‘কম প্রগতিশীল’ এমন দেশ থেকে অভিবাসী আসাটাকেও তারা পছন্দ করছে না – কারণ তারা দেখছে যে এর ফলে পশ্চিমা সমাজের প্রগতিশীল আদর্শগুলোই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। একে একটা স্ববিরোধিতাই বলতে হবে,” বলছিলেন ফ্রেডরিক সেগারফেল্ড।
তবে অধ্যাপক রবার্তো দা’লিমন্ত বিষয়টিকে দেখতে চান ভিন্নভাবে।
তার কথা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমনটা হয়েই থাকে এবং অতিডানপন্থীদের এ উত্থান হয়তো একটা সাময়িক ব্যাপার।
তিনি বলেন,”আমরা এত অবাক হচ্ছি কেন? এটা গণতন্ত্র । মানুষজন মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, অভিবাসন এসব নিয়ে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা চায়। বামপন্থী দলগুলো এই সব মানুষদের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্যই তারা ডানপন্থীদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এখানে হতাশ হলে তারা হয়তো আবার বামপন্থীদের দিকে তাকাবে। মানুষের সমর্থন পেন্ডুলামের মতো একবার এদিকে একবার ওদিকে যাবে – গণতন্ত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। আমার মনে হয় আসল প্রশ্ন হচ্ছে – যারা ক্ষমতায় আসছে তাদের দেশ পরিচালনার সক্ষমতা আছে কি না। ”
অভিবাসীদের জন্য কতটা উদ্বেগের
প্রতিবছর ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ও স্থলপথে বহু মানুষ ইতালিতে যান। এদের মধ্যে প্রচুর বাংলাদেশিও রয়েছেন। এই মুহূর্তে দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করছেন এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি। এখনও কাজকর্ম ও চাকরির বৈধ কাগজপত্র নেই কিংবা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
ডানপন্থিদের জয়ে রাজধানী রোম ও ভেনিসে কাজ করছেন এমন বাংলাদেশিদের মধ্যে এক ধরনের চাপা উদ্বেগ কাজ করছে। যারা ইতোমধ্যেই কাজ ও বসবাসের বৈধ কাগজপত্র পেয়েছেন তাদের মধ্যে অবশ্য উদ্বেগ কিছুটা কম।
কিন্তু যারা এখনও স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাননি তাদের আশঙ্কা, নতুন সরকার অভিবাসন নীতি কঠোর করলে তাদের বৈধতা পেতে সমস্যা হবে। এছাড়া মুসলিমবিরোধী মনোভাবের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মনে।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, অভিবাসীদের প্রতি যত কঠোরই হোক, হয়তো তাদের সরাসরি দেশে ফেরত পাঠাবে না এই সরকার। কিন্তু নানা নিয়মকানুন করে তাদের চাপে রাখা হবে। তবে অনেকের আশঙ্কা, নতুন সরকার অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে আইন করবে এবং সেই সঙ্গে অভিবাসনবিরোধী প্রচারণা চালাবে। তাতে সমাজে ‘ইতালীয় বনাম বিদেশি’ এমন একটি বিভাজন তৈরি হবে।
অভিবাসীদের জন্য ইতালিতে বেকারত্ব ও অপরাধ বেড়েছে বলে মনে করে থাকেন দেশটির অনেক নাগরিক। এ কারণে নতুন সরকার এসে অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক ও অপরাধ ঠেকাতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে অভিবাসীরা নানা হয়রানির শিকার হতে পারেন বলেও শঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া এসব চাপের কারণে নতুন অভিবাসীদের ইতালিতে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করা হতে পারে। সমুদ্রপথে আসা অভিবাসীদের প্রবেশ মুখগুলোতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে। সমুদ্রপথের প্রবেশ মুখগুলোতে রেডক্রসের মতো যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে, তাদের কর্মকাণ্ডে দেয়া হতে পারে নিষেধাজ্ঞা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৭
আপনার মতামত জানানঃ