বিএনপি যেভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, এটা অব্যাহত থাকলে দলটির কর্মীরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবতে শুরু করবেন। তারা বাধা উপেক্ষা করে পাল্টা হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারেন বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বিএনপির আন্দোলন থামানোর উপায় খুঁজছে সরকারি দল।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে টানা কর্মসূচি পালন করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এসব কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত হচ্ছে দলের কর্মীদের। আঘাত এলে পাল্টা আঘাত হবে—বিএনপির পক্ষ থেকে এমন কথাও বলা হয়েছে। এই অবস্থায় সংঘর্ষ এড়িয়ে বিএনপিকে মাঠে রাখার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের চাওয়া, বিএনপি মাঠে থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে সহিংস দল হিসেবে দেশ-বিদেশে চিহ্নিত হোক।
আওয়ামী লীগ বিএনপির পাল্টা কর্মসূচির কথা বললেও এখনই সহিংসতায় জড়িয়ে রাজনীতির মাঠ অস্থিতিশীল করতে চায় না। দলের নেতারা বলছেন, বিএনপির নেতারা উসকানি দিয়ে সহিংসতার ফাঁদ পেতেছে। তাদের সেই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, অতীতে বিএনপি কর্মসূচির নামে জ্বালাও-পোড়াও করেছিল। এখন বিভিন্ন সভা- সমাবেশে তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। অনেক জায়গায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। দলটি কর্মসূচির নামেই সহিংসতা করে—এমন চিত্র দেশ-বিদেশে তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বিএনপির নেতাদের নামে যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলো সচল করা এবং মামলায় বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার-আতঙ্ক ছড়ানোর কথাও বিবেচনায় আছে। এর বাইরে দলের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কারা কারা আর্থিক ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের তালিকা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।
দলীয় উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার একাধিক সমাবেশে বিএনপির কর্মীরা লাঠি নিয়ে এসেছেন। সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন। বিএনপি আন্দোলনের নামে সহিংসতা করতে চাইছে, সেটা প্রমাণ করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন সরকারি দলের নেতারা।
তাই বিএনপির কর্মীদের লাঠি নিয়ে সমাবেশে আসার বিষয়টি সামনে আনা হবে। তাতে ‘সহিংসতা’ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুরোমাত্রায় বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা আছে। ঢাকায় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা হচ্ছে। তবে সব কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। কোথাও ছাড়, কোথাও বাধা দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। তবে ঢাকার আশপাশের কর্মসূচির ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি কঠোরতা দেখানো হচ্ছে। পুলিশকে গুলিও করতে হয়েছে। এরপরও বিএনপি কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টার চিন্তা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, বিএনপির কর্মসূচি থামাতে দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে সুবিধামতো কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে সরকার সমালোচনায় পড়ছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। তাই বিএনপিকে সহিংসতার দায় দিয়ে চাপে ফেলা সবচেয়ে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি সহিংস হওয়ার পর তাদের দমন করা সহজ হয়েছিল।
ক্ষমতাসীনদের চাওয়া, বিএনপি মাঠে থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে সহিংস দল হিসেবে দেশ-বিদেশে চিহ্নিত হোক।
দলীয় সূত্র জানায়, একদিকে বিএনপির আন্দোলনের চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রকট। আগামী জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে তৃণমূলেও সম্মেলন চলছে। এতে বিভিন্ন স্থানেই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখা যাবে কি না—এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করার উপায় খুঁজছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
এদিকে এরই মধ্যে ৮ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ সাংগঠনিক বিভাগীয় শাখায় মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। যাতে করে দেশের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, কর্মসূচির নামে বিএনপির সহিংসতা করার চেষ্টা প্রতিহত করতে মাঠে থাকবেন তারা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা সহিংসতা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করব। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাব।’
তৃণমূলের সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সচল রেখেছে বলে জানিয়ে দলের নেতারা বলছেন, আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিভিন্ন ইউনিটের সম্মেলন হচ্ছে। এসব সম্মেলনে নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা চলছে।
ফারুক খান বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে চাইলে কোনো বাধা নেই। তবে গত দুই দশকে বিএনপির কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, তারা সমাবেশের নামে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। আবার পুলিশের সঙ্গে মারামারি করে জানমাল নষ্ট করার চেষ্টা করে। দলটি সহিংসতায় জড়ালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতীতের মতো এবারও ব্যবস্থা নেবে।’
আগের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা আছে। এবার বিএনপিকে মাঠে নামার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি কীভাবে মাঠছাড়া করা যায়, সেই পরিকল্পনাও চলছে।
এদিকে প্রায় ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারপরও বর্তমান সরকারের অধীনে কর্মরত পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অধীনে নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছেন দলটি। সে ভয় থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছে।
তবে দলটি শুধু আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্বাচনী দায়িত্বে রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে ইসির অধীনে ন্যস্ত করাসহ ১৪ দফা লিখিত প্রস্তাব করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ