গত দুই দশকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গ্রীষ্ম মৌসুমে মারাত্মক তাপপ্রবাহের শিকার হয়েছে। এ দুই দশকের মধ্যে ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে ১৯ বার। আবার এ সময় আবহাওয়া-সংশ্লিষ্ট দুর্বিপাকের ঘটনাগুলোও দেখা গিয়েছে বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামনের দিনগুলোয়ও বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকির মুখে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোই এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে গোটা বিশ্বেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এ ধরনের দুর্যোগের মাত্রা ও ভয়াবহতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিকে দুর্যোগজনিত মোট অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটছে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়। এদিক থেকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ।
২০২০ সালের ২০ মে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা উপকূলে তীব্র শক্তিতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও এর প্রাদুর্ভাবজনিত টানা ঝড়বৃষ্টিতে বাংলাদেশে পৌনে দুই লাখ হেক্টরেরও বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানি ও জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও উপকূলীয় কয়েকটি জেলার প্রচুর মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হয় তাদের অনেকেই।
এর আগের বছরের মে মাসেও আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ আরেক ঘূর্ণিঝড় ফণী। সে সময় দুই দেশের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। গত এক দশকে এমন অনেক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুধু উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস নয়; খরা, বন্যা, নদীভাঙন ও অতিবৃষ্টির আঘাতেও প্রতি বছর প্রচুর মানুষ নিজের আবাসস্থল হারিয়ে দেশের অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। আবার গত বছরের মে মাসে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ইয়াশের প্রভাবেও দেখা গিয়েছে এ চিত্রের পুনরাবৃত্তি।
ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস তাত্ক্ষণিকভাবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ঘটাচ্ছে। আবার নদী শাসন, বন উজাড় ও ভূমিক্ষয়ের মতো বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকায় প্রভাব ফেলছে ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে। এগুলোর ধারাবাহিকতায় বন্যার মতো দেখা দেয়া আকস্মিক দুর্যোগগুলোও প্রচুর মানুষকে এলাকাছাড়া হতে বাধ্য করছে। ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শুধু ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৮৯ হাজার মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের বাসিন্দা।
দেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির একটি বড় কারণ ধরা হয় নদীভাঙনকে। বাঁধ নির্মাণসহ নানা উপায়ে অপরিণামদর্শী নদী শাসন, সংলগ্ন খাল ভরাট ও পানিপ্রবাহের গতিপথ সংকুচিত হয়ে আসার কারণে প্রতি বছরই দেশের নদ-নদীগুলোর তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা যাচ্ছে। নদীতে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি ও গোচারণভূমি। জীবন-জীবিকা হারিয়ে শহরাঞ্চলে এসে ভিড় করছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে পানিসম্পদ অব্যবস্থাপনাকে বড় একটি অনুঘটক হিসেবে দেখছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির বড় কারণই পানি। বাংলাদেশের নিজস্ব পানিসম্পদের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভারতের পানি বণ্টন নীতির কারণেও এ দেশের মানুষ খরা ও বন্যার মতো দুর্যোগে পড়ছে।
তিনি বলেন, দেশের ১৪৫টি উপজেলা ও ১৩টি জেলায় ভয়াবহ নদীভাঙন ঘটছে। রাজশাহীতে গ্রাউন্ড ওয়াটার কমে গিয়েছে। খুলনায় মিঠাপানির সংকট। রংপুরে তিস্তার ভাঙনসহ দেশের যেখানেই বাস্তুচ্যুতি হচ্ছে, সেখানেই পানি বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু দুর্যোগ নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা এখনো পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতন হননি। বেসরকারিভাবে তো বটেই সরকারিভাবেও বহু খাল, নদী, বিল, পুকুর ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার ফলে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।
ঘরবাড়ি হারানোতেই থেমে থাকছে না দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতদের দুর্ভোগ। পরেও নানা ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা। বিশেষ করে দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত নারীরা পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন বলে এডিবির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়ছে। একই সঙ্গে শিশু ও শারীরিকভাবে অক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরাও নানা ধরনের হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ