প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন বর্তমানে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ধরনটাও পাল্টে গেছে। পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করার চেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের খোঁজে।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, মিছিল প্রভৃতি অরাজকতা। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও দুর্নীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছি আমরা, যা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি এখন আর নতুন কিছু নয়। আশঙ্কার বিষয় হল, বর্তমান প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে শিক্ষাজীবনেই দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতির এক অভিনব পদ্ধতি প্রশ্নপত্র ফাঁস।
এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা; বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মামলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ২০০৯ সাল থেকে ১৪ বছরে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হয়েছে দুই শতাধিক মামলা। তবে এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে শুধু ৪৫টির। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির অর্থদণ্ড হয়েছে ৫ হাজার টাকা।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, ভুল আইনে মামলা, সাক্ষী হাজিরের ব্যর্থতা ও তদন্তের গাফিলতিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান ও দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের মামলাবিষয়ক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকায় দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির অভিযোগই বেশি। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ সালের বিভিন্ন ধারায় এসব মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সনদ বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধ রয়েছে। এগুলো ঢাকার আদালতে বিচারাধীন।
অন্যদিকে ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কিছু মামলা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও করা হয়েছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।
এদিকে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায়ও মামলা করা হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষা আইনে। ঢাকার আদালতের দেওয়া এক রায়ে বলা হয়েছে, ‘ভুল আইনে মামলা করা হয়েছে’।
অভিযোগপত্রে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় আবিদা নামে একজন ‘ভুয়া পরীক্ষার্থী’ ধরা পড়েন। পরে তার বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩-এর ক ধারায় মামলা হয়। ওই মামলায় ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন ঢাকার আদালত। রায়ে বলা হয়, চাকরির পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষা নয়। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান নেই।
সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে বক্তব্য দেন সেটি কোনো কারণে তারা আদালতে দেন না। আবার ভুল আইনেও কিছু কিছু মামলা হচ্ছে, যা আদালতের রায়েও এসেছে। এসব কারণে আইন থাকার পরও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, গত ১৪ বছরে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় শুধু মেহেদী শামীম নামে একজনকে জরিমানা করা হয়েছে। তিনি ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়্যারলেস অপারেটর পদের নিয়োগ পরীক্ষার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পরিচয় গোপন করে আতিকুর রহমান সেজে পরীক্ষায় অংশ নেন। পরে এ ঘটনায় করা মামলায় ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর এ মামলার রায়ে আসামিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে আসামির বিরুদ্ধে প্রতারণার (দ বিধির ৪১৯ ধারা) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর দোষ স্বীকার করায় আদালতের রায়ে আসামিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘আইন সংশোধন না করলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা দুরূহ। বলা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে যথাযথ আইনই নেই। যেটা আছে তাতে শাস্তি অনেক কম। এ জন্য বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। কারণ তদন্ত কর্মকর্তাকেও আইন অনুযায়ী তদন্ত করতে হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী অভিযোগপত্র দিয়ে থাকেন। প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের।’
পরে বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের নজরে দেওয়া হলে ঢাকা মহানগর আদালতের প্রধান কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘মামলা দায়েরে দুর্বলতা থাকলে বিচার যথাযথ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার সাক্ষী দিতে যারা আসেন তারাও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় উল্টোপাল্টা বলেন। অর্থাৎ সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে বক্তব্য দেন সেটি কোনো কারণে তারা আদালতে দেন না। আবার ভুল আইনেও কিছু কিছু মামলা হচ্ছে, যা আদালতের রায়েও এসেছে। এসব কারণে আইন থাকার পরও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।’
বিদ্যমান আইন সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সংসদে যারা আছেন তাদের বিষয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটি সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত। কারণ প্রশ্ন ফাঁস ঘৃণ্য অপরাধ। এর ফলে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।’
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি দুরারোগ্য ব্যাধির মতো জেঁকে বসেছে। কোনোভাবেই এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি প্রেসের কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা অনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয় শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অবিলম্বে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে যোগ্য লোক বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তারা বলেন, প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে? এই যে চিত্রটা এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ