গত দুই বছরে করোনা প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। এ সময় তাদের যেমন বিক্রি ও আয় কমেছে তেমনি লোকবলও ছাঁটাই করতে হয়েছে। বহু ছোট উদ্যোক্তা কারখানা বন্ধ করতে কিংবা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছেন।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টার্নেটিভ ফাইন্যান্সিং ইনস্টিটিউশনস (ইনাফি) বাংলাদেশের গবেষণা অনুসারে, করোনার অভিঘাতে দেশের ৮৩ দশমিক ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার আয় কমেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে ৪০ শতাংশ চাকরি হারিয়েছেন। ২২ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা ঋণের কিস্তির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেননি। সাড়ে ৫ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাননি। আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সঞ্চয় ভেঙেছেন ৪৭ শতাংশ উদ্যোক্তা। ২১ শতাংশ উদ্যোক্তা নিজের সম্পদ বিক্রি করেছেন।
করোনা সংক্রমণে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অভিঘাতের বিষয়ে ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের ওপর করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টার্নেটিভ ফাইন্যান্সিং ইনস্টিটিউশনস (ইনাফি) বাংলাদেশ এই গবেষণাটি পরিচালনা করে। সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে ইনাফি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
ইনাফি বাংলাদেশের চেয়ারপারসন এসএন কৈরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। বিশেষ অতিথি মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ইনাফির প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসনোভা ফারহেম।
প্রতিবেদনে তিনি বলেন, দুই বছরে এই খাতে সম্পৃক্ত মানুষের ওপর জরিপ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। করোনায় তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে নীতি সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, করোনায় সরকারি প্রণোদনা কীভাবে মানুষকে সাহায্য করেছে, সেটা নিয়েও পর্যাপ্ত গবেষণা প্রয়োজন।
এমআরএ-এর নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ জানান, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সংকট নিরসনে তারা কাজ করছেন। তাদেরকে সহজ শর্তে তহবিল জোগান দেওয়ার জন্য নীতিমালা সহজ করা হয়েছে।
দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। করোনায় তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে নীতি সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন।
গত বছর গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের এক যৌথ জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ছোট ব্যবসায়ীদের বিক্রি করোনার আগের চেয়ে ৮৬ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আয় কমেছিল ৬৬ শতাংশ।
অবশ্য করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই প্রণোদনার অর্থ দেয় ব্যাংকগুলো। সুদের অর্ধেক সরকার দেয়। কিন্তু এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সেই প্রণোদনা সুবিধা নিতে পারেননি।
করোনা শুরুর এক বছর পর জরিপ করেছিল আরেক গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এ গবেষণায় বলা হয়, মাঝারি শিল্পের ২৮ শতাংশ ও ক্ষুদ্র শিল্পের ১০ শতাংশ উদ্যোক্তা প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। জানা গেছে, শুধু তারাই প্রণোদনা–সুবিধা পেয়েছেন, যাদের আগে থেকেই ব্যাংকঋণ ছিল।
ছোট কলকারখানা স্থাপনেই এখন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেশি। বদৌলতে দেশে দিন দিন ছোট কলকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। গত এক দশকে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে সাত হাজারের বেশি। উদ্যোক্তাদের ছোট কলকারখানা গড়ে তোলার দিকে ঝোঁকার অন্যতম কারণ হলো, এতে তুলনামূলক কম বিনিয়োগ লাগে। বড় বড় শিল্প এলাকার বাইরে গিয়েও অল্প পুঁজিতে কারখানা স্থাপন করা যায়। এভাবেই ছোট কারখানাগুলো এখন হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রাণ।
ব্যাংকঋণ সহজলভ্য না হলেও নিজের জমানো টাকা, স্বামী বা স্ত্রী কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্জ নিয়েই ছোট কলকারখানায় বিনিয়োগ করেন ছোট ও নবীন উদ্যোক্তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত। কারণ, জামানত দিতে না পারলে ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় না। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে জামানত দেওয়া কঠিন। তাই তাদের জন্য ব্যাংকঋণ পাওয়া দুষ্কর। যে কারণে ছোটরা আর বড় হতে পারে না।
তারা আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ জন্য তাদের এগিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ